কবি সাদিক ও আমি
সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া তথা কুমারখালীর প্রথিতযশা, অভিজ্ঞ, বয়স্ক, কবিদের কবি, সৈয়দ আবদুস সাদিক আর নেই। কুষ্টিয়া কুমারখালীর অগুনিত কবি, সাহিত্যিকদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি (৩১.১২.১৯৪৪-১৯.১০.২০২৪)পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আমরা যারা তাঁর স্নেহধন্য তাদের মনটা ভীষন বিষন্ন। তাঁর সাথের অনেক স্মৃতি বারবার মনে পড়ছে। প্রথমেই তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
কবি সাদিককে আমি প্রথম দেখি কুমারখালীর কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানে। আগেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছেছিলাম। লোকজন তখন ও তেমন একটা আসেননি, অল্প কয়েকজন। একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে দেখলাম এগিয়ে আসছেন। সালাম দিলাম। বললেন বসুন। এই পর্যন্তই। আর এক বৎসরের মধ্যে তাঁর সংগে কোনো পরিচয় নাই। বছর ঘুরতেই কবি সাদিকের সাথে পরিচয় হলো। প্রথম সাক্ষাতেই কবি সাদিক আর লিটন আব্বাস আমাকে বই উপহার দিলেন। টারবোতে অনেক গল্প অনেক আলোচনা। বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা।
বই উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর আর থেমে থাকি নাই। চলেছে আড্ডা, গল্প, কবিতা। রনজক রিজভির মানুষের মিছিলে কবিতা গ্রুপ, কবিতা উৎসব গ্রুপে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। কতো কবিতা যে লিখেছি! উনি কখনও ঠিক করে দিতেন, কখনও উৎসাহ দিতেন, আবার কখনও মজা করতেন।
একুশের বইমেলায় যেয়ে তাঁর কবিতার বই, "কবিতা সমগ্র" ২য় খন্ড কিনলাম। পড়তে শুরু করলাম। ভালো লেগে গেল-,
ছড়া
ধুর শালা!
ছড়ায় কোনো কাজ হবে না
সাপ মারতে লাঠি লাগে
লাঠি চালা-,
ধুর শালা!
সবাই কেমন অন্ধ, বোবা,কালা
সবাই মুখে দিয়ে আছে তালা
ধুর শালা!
ছড়ায় কোনো কাজ হবে না
লাঠি চালা!
লাঠি চালা!
কবি সাদিক অনেক বয়স্ক ছিলেন। তাঁর সাথে কোনো তর্ক বিতর্ক চলে না। হয় ও নাই কোনোদিন। তবে খুনসুটি চলেছে বিস্তর। ঠিক যেন কোথাও বেড়াতে যেয়ে কোনো বাংলোর জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি হাত বাড়িয়ে ধরার মতো। সামান্য সময়ের আনন্দে ভাসা।
গ্রুপে কতো কথা বলেছি! তিনি সাধ্যমত উপস্থিত থেকেছেন। রসিকতা করেছেন। সবার সাথে সামিল হয়েছেন। মিশেছেন সর্বস্তরের মানুষের সাথে, আর তাই তাকে আজ এতো মানুষ ভালোবাসছেন, দোয়া করছেন, স্মরণ করছেন।একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!
মানুষের মৃত্যুর পরের মূল্যায়ন সবার ভাগ্যে জোটে না। সবাই সবাইকে ভালো বলে না! কবি সাদিক এদিক দিয়ে অনেক ভাগ্যবান। বোঝা যাচ্ছে ছোট,বড়, অল্প পরিচিত, বেশি পরিচিত সবার সাথে তিনি মিশেছেন, সবার মন জয় করেছেন। তিনি সবাই কে সমাদর করেছেন বলেই নিজেও আজ সমাদৃত।
বেশ কিছুদিন আগে এমনও হয়েছে অনেক রাতে একটা গ্রুপে হয়ত লিখেছি, শুভ রাত্রি। কিছুক্ষণ পরেই উত্তর এসেছে শুভ রাত্রি। আমার জন্য এটা দারুণ একটা ব্যাপার ছিলো! কতোদিন বলেছি, এখন ও ঘুমান নি? শরীর খারাপ করবে তো! এরকম প্রায়ই হতো।
পরিচয় বেশী দিনের না, গ্রুপে আড্ডার কারণে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। দেখা হয়েছে কম। তবে আড্ডা হয়েছে তুমুল। প্রায় ই রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন বলতেন, লিখতেন। আমি অনেক কিছু বলতাম। তিনি
প্রাণ খুলে উপভোগ করতেন। একবার তাঁকে বললাম আমাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখতে হবে। তিনি হাসলেন।পরদিন ঠিকই অদ্ভুত সুন্দর এক কবিতা লিখে আমাকে উপহার দিলেন। আমি তাকে উপাধি দিলাম, - "হিরো কবি।"
কেন দিবো না! কবিতাটা যে আমার মনের মতো ছিলো। কবি অনেক বয়স্ক ছিলেন কিন্তু মনটা ছিলো তারুণ্যের এটা বোঝা যায়! কেমন করে যেন আমাদের কয়েকজনের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। গ্রুপে যখন যা লিখেছি মজা করে উত্তর দিয়েছেন। যা- ই লিখতাম দেখতেন।আমি ও উনাকে আমার মতো করেই সব বলতাম। কোনো সংকোচ ছিলো না । একটা ব্যাপার আমার কাছে অবাক লাগতো! তিনি সব সময় আপনি বলে সম্বোধন করতেন। বলেছিলাম আমি আপনার অনেক ছোট। তারপরও আপনি বলেছেন।
উনার কাছে বেশ কিছু আব্দার করেছি। বললাম, আমার কবিতার বই এর জন্য কিছু লিখে দেন। প্রথমে তো না, না। যখন বললাম থাক লাগবে না (অভিমান করে) তখন লিখে দিলেন । আমার সৌভাগ্য যে উনার লেখাটা আমার কবিতার বইয়ের পাতায় সব সময় থাকবে।
কবির সাথে আমার দেখা হয়েছে কম। কিন্তু গ্রুপের কারণে তাঁর খোঁজ খবর সব সময় নিতে পারতাম। কিছু দিন আগেও তাঁর খোঁজ নিয়ে বললাম এখন কেমন আছেন, বললেন ভালো আছি। তার পরই দুঃসংবাদ শুনলাম।
আর কি কবির সাথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা নিয়ে আমার অল্প বিস্তর ঘটনাবলীর স্মৃতিকথা স্মরণ করলাম। কতো মানুষের কতো স্মৃতি আছে! আমার সামান্য স্মৃতি এটুকুই বললাম । ইচ্ছে ছিলো কবির বাসভবন "তবুও বসবাস" এ যাবো। কবি থাকা অবস্থায় হলো না। হয়তো একদিন যাবো!
কবি নিজ এলাকায় থেকেছেন। পরিচিত পরিবেশ, লোকজন সবই কাছে পেয়েছেন। নিজের এলাকায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভালোবাসার ক্ষেত্র তৈরী করেছেন। রকিবুল হাসান ঠিকই বলেছেন, নিজের এলাকার মানুষের ভালোবাসা পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। যা তিনি পেয়েছেন।
পরিশেষে আবার ও কবির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। কবি আছেন আমাদের মাঝে, থাকবেন যুগ যুগ ধরে তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের কারণে । আলোচিত হবেন প্রতিটি সাহিত্যের আসরে! এখন তিনি আছেন আমার ই পাশে!
যেখানে আমি প্রতিনিয়ত যাই আমার প্রিয় মানুষটার জন্য কবর জিয়ারত করতে । এখন থেকে কবিও থাকবেন আমার প্রার্থনায়। কবিকে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা জান্নাতের উচ্চতম মাকাম দান করুন। তাঁর সমস্ত গোনাহ্ মাফ করে দিন। আমিন।
লেখক: কবি
১৯৭ বার পড়া হয়েছে