সৈয়দ আবদুস সাদিক: স্মরণেষু
সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ ৩:৫৩ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক ছিলেন আজন্ম সৃষ্টিশীল। সৃজনকর্মের মধ্যগগণস্তরে তার সঙ্গে, তার কর্মের সঙ্গে পরিচিত হলেও জীবন সায়াহ্নের বছরগুলোতেই ঘনিষ্ঠ হই। কেন জানি না আগে থেকে মিথস্ক্রিয়াময় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি আমাদের।
নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন একান্ত নিজস্ব কাব্যজগৎ। যে জগতে ছিল সৃষ্টির উন্মাদনা, লেখকসুলভ আভিজাত্য, গর্ব এবং বন্ধুতার বিপুল বৈভব। ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন পারহেসিয়াময় সত্যকথনে অকপট, সাহসী; তেমনি সামাজিক ভাড়ামির প্রতি তার কবিতা শিল্পময় রক্তচক্ষু দেখাতেও ছাড় দেয়নি।জাতীয়স্তরের কবি হলেও তিনি কর্মসূত্রে বিভাগীয় শহরের জীবনকে উপভোগ করে গেছেন জীবনের সিংহভাগ। জীবনের প্রান্তিক দশখে থিতু হয়েছিলেন নিজ জন্মস্থান কুষ্টিয়ার উপজেলা শহর কুমারখালীর উপকন্ঠে, নিজস্ব স্বপ্নজগৎ ‘তবুও বসবাসে’।
নগর বা কেন্দ্র থেকে দূরের সাহিত্যিক পরিমন্ডলে অবস্থান করলেও স্থানীয় ননন্দচর্চার সক্রিয় অংশীজন হতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁর জৈষ্ঠ্যতা। কারণ কবি সৈয়দ সাদিক তারুণ্যঘেরা জীবনকে আরাধ্য করেছিলেন। তার মিশুকে স্বভাব, বন্ধুপ্রিয় মন জীবনের অবসরে তারুণ্যকে সঙ্গী করে বহুদূর যাওয়ার পথকে আঁকড়ে ধরেছিল।
একই জনপদের মানুষ হওয়ায় তার সঙ্গে সাহিত্যিক ঘনিষ্ঠতা হতে খুব বিলম্ব হয়নি আমার। প্রযুক্তিমাধ্যমে কথাবার্তা হতো। সরাসরি কিংবা দূরালাপনে যতো কথাবার্তা বলেছি, ততো তার কন্ঠ থেকে ঝরে পড়েছে হতাশার সুর। সব সময়ই তিনি আক্ষেপ করতেন , কারও কিছু হচ্ছে না। সাহিত্য ও কাব্য চর্চায় আরও নিবেদিত হতে হবে তরুণদের। এরকম উৎসাহজাগানিয়া কথাবার্তা তার কাছ থেকে সব সময় শোনা যেতো।
নন্দনচর্চায় এ জাতি সবসময় বয়স ও উচ্চতার মাপকাঠিতে বটবৃক্ষসম মুরুব্বি অনুসন্ধানমুখী। অগ্রজের দেখিয়ে দেয়া পথে চলতে চায় তারুণ্য। অন্তত: বাংলা সাহিত্য চর্চায় পরম্পরাপ্রশ্নে মুরুব্বি ও অগ্রজের বড় প্রয়োজন। কী জাতীয় ক্ষেত্রে, কী আঞ্চলিক ক্ষেত্রে আমরা অগ্রজের পরামর্শ, উপদেশ ও নির্দেশনায় করতে চাই নিজেদের সাফল্যের নিশানা। কুষ্টিয়ার কুমারখালী অঞ্চলে একসময় অধ্যাপক রশিদুর রহমান ওরফে মিলি রহমান তখনকার তরুণদের অগ্রভাগে থেকে সেই অগ্রজের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার অনন্তযাত্রার ফলে যে শূণ্যতা বহুদিন অঞ্চলের সৃষ্টিশীলদের দিশাহীন রেখেছিল, সদ্যপ্রয়াত কবি সৈয়দ আবদুস সাদিকের হাত ধরে সে শূণ্যতা সহসাই পূরণ হয়েছিল। বতর্মানের শূণ্যতায় সামনে আসে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সৈয়দ আবদুস সাদিকসেই কবি- যিনি জাতীয় স্তরে সাহিত্য চর্চা করতে করতে দূরজীবন বেঁছে নিয়েছিলেন। সেটা হতে পারে তার নিজস্ব প্রকৃতিপ্রেমে, হতে পারে সৃজনপ্রয়োজনে কিংবা হতে পারে বৈষয়িক জীবনজনিত। কিন্তু দূরচর্চা তাকে কেন্দ্র থেকে অন্তত মানসিবভাবে কখনো বিচ্যূত করেনি। সৈয়দ আবদুস সাদিক যে মাপে নিজেকে তৈরি করে উপস্থাপন করেছেন এ জাতির সামনে, তার পুরোটা প্রাদপ্রদীপে পেশ হয়েছে বা হয়ে গেছে তা মনে করি না। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ললাটলিখন এমনই যে, সৃষ্টিশীলদের অনেকেই প্রত্যাশিত রকমে যথাসময়ে সামনে উঠে আসতে পারেন না, কিংবা আপামরের কাছ থেকে অনেকখানি চাপা পড়ে থাকেন। পরবর্তী তরুণ সৃষ্টিশীলদের দায়িত্ব হচ্ছে মূল্যায়ণবঞ্চণার প্রায়ান্ধ অবস্থা থেকে সেসব অগ্রজের সৃষ্টিকে সামনে তুলে আনা। আলোকিত করা।
সৈয়দ আবদুস সাদিক এর জন্য সেই কাজ এখন তরুণদের সামনে অপেক্ষমান।
লেখক: কবি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
১৯৫ বার পড়া হয়েছে