দুই দশকের রাজনৈতিক মামলা: দায়, বিচারের বৈষম্য ও ইতিহাস
সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫ ৫:৪৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৯৯০ দশকের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বড় বাস্তবতা ‘বিচার রাজনীতি’, যা রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
প্রবীণ দুই নেত্রী—বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত দুই দশকে রাষ্ট্রের আইনি অভিযানের রূপরেখা, অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের বিচারিক ব্যবস্থাপনা এবং ২০২৪ সালের গণআন্দোলনে রাষ্ট্রের দায় ও অনিয়ম, আমার আজকের এই প্রতিবেদনের মূল পাঠ্য।
১/১১ সরকারের আমলে দুই নেত্রীকে ঘিরে মামলা
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হয়; ক্ষমতায় বসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে রাষ্ট্রীয় শক্তির মুখ্য লক্ষ্য হয়ে ওঠেন দুই নেত্রী—শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।
শেখ হাসিনা: ১/১১ সরকারের সময় (২০০৭-২০০৮) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্তত চারটি মামলা হয়—যার মধ্যে ছিল চাঁদা দাবি, অবৈধ লেনদেন, ও হত্যা মামলা।
খালেদা জিয়া: একই সময়ে তার বিরুদ্ধে অন্তত ১০-১৫টি বড় মামলা হয়—যার মধ্যে Niko, Gatco, Barapukuria খনি, Zia Orphanage Trust, ও Zia Charitable Trust দুর্নীতি মামলাসহ ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত মামলা অন্তর্ভুক্ত।
মামলা নিষ্পত্তির পরিণতি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুই নেত্রীর মামলার গতিপ্রকৃতি আমূল বদলে যায়।
নতুন সরকারে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হয় বা বাতিল হয়ে যায় ২০০৯-২০১২ সালের মধ্যে। বিচারাধীন অবস্থায় হাজির না হয়েই খালাস পান।
অন্যদিকে, ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলতে থাকে স্থগিত, জামিন ও আপিলের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ২০১৮ সালে দুটি দুর্নীতি মামলায় (Zia Orphanage Trust, Zia Charitable Trust) দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যান—এই বন্দিত্ব মিলে যায় প্রায় সাত বছর, যদিও পরবর্তীতে (২০২৪-২০২৫) উচ্চ আদালত সবগুলো মামলায় তাকে খালাস দেন।
২০১৪ সালের পর অজস্র গায়েবি মামলা
২০১৪ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গায়েবি ও ‘নাশকতার’ অভিযোগে একের পর এক মামলা দায়ের হতে থাকেঃ
২০১৪ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে ১০৯টি মামলা রেকর্ড হয়েছে, অধিকাংশই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, সহিংসতায় উস্কানি সংক্রান্ত।
অধিকাংশ মামলায় তার ‘প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের’ লিখিত প্রমাণ নেই, বরং হুকুমদাতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিযোগ।
আদালতে বৈষম্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, একই অপরাধে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দুই নেত্রীর বিচারের পরিণতি ভিন্ন মাত্রার। শেখ হাসিনা সরকারে এসে কার্যত নিজের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করেছেন, ব্যাপক মূল মামলায় হাজিরা না দিয়েই খালাস পেয়েছেন। অপরদিকে, বিরোধী দলে থাকা খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ বন্দিত্ব, বারবার জামিন প্রত্যাখ্যান, এবং দীর্ঘ বিচারে অংশ নিতে হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্ষমতা ও রাজনৈতিক পদাধিকারীদের জন্য ভিন্ন মাপকাঠি রেখে চলে—বাংলাদেশে ‘বিচারিক বৈষম্য’ বাস্তবতা এখানে স্পষ্ট।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রীয় দায়
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ ও ‘কোটাপ্রথা সংস্কার’র আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের গুলিতে, লাঠিচার্জে, নির্মম নির্যাতনে ৮০০এর বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের রিপোর্টে আহতের সংখ্যা আরও বেশি হিসেব করা হয়েছে।
সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ছাত্রলীগকে সরাসরি মাঠে নামার নির্দেশ দেন; অথচ আইনি ও সংবিধানিকভাবে জরুরি আইন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের একমাত্র সিদ্ধান্তের মালিক সরকার প্রধান নিজেই।
জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মহল এটিকে State-led Massacre হিসেবে আখ্যা দেয়, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় ‘প্রত্যক্ষ গণহত্যা’ হিসাবে চিহ্নিত হয়।
আইনের চোখে দায়-দায়িত্বের তুলনা
বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘রাজনৈতিক উস্কানি’—যেখানে সরাসরি অংশগ্রহণের স্বাক্ষ্য ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বারবার গণহত্যা, নির্মম হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরাসরি দায় বর্তায়—কারণ রাষ্ট্রীয় অস্ত্র তার অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করা যায় না এবং সবকিছু তার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নির্ভর করে।
সরকারপ্রধানের দায় অস্বীকার ও ষড়যন্ত্রের যুক্তি
শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও বড় মাপের গণহত্যার ঘটনায় বারবার দাবি করেছেন, তিনি কোনোভাবেই সরকারি বাহিনীকে জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে লিখিত বা মৌখিক কোনো নির্দেশ দেননি; বরং পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া ও সহিংস আন্দোলন মোকাবেলার জন্য প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী নিজেদের উদ্যোগে কার্যক্রম পরিচালনা করে। সরকারপক্ষ দাবি করে, আন্দোলনের সহিংস রূপ ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ‘genocide’ প্রচারণা এবং ব্যাপক অপপ্রচারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি ও উৎখাতের ষড়যন্ত্র হয়েছে।
শেখ হাসিনার মতে, এসব ঘটনায় তার কোনো ‘command responsibility’ নেই এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাড়াবাড়ি হলে সেটি তাদের ব্যক্তিগত কিংবা স্থানীয় সিদ্ধান্ত; তিনি কখনো রাষ্ট্রের স্বার্থে পরিকল্পিত প্রাণসংহার চাননি বা অনুমতি দেননি। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার বিশ্লেষক এবং দেশীয় বিরোধী গণমাধ্যমের মতে, এত বড় রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দায় সরকার প্রধান বা রাজনীতিক প্রশাসনিকভাবে এড়াতে পারেন না—কারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নীতিগত নির্দেশ ছাড়াই দেশজুড়ে সমন্বিত সরকারি শক্তি ব্যবহার অসম্ভব, আর প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক, লিখিত বা প্রশাসনিক অনুমোদন রেখেই এই দমন-নির্যাতন চালানো হয়।
শেষ কথা
দুই নেত্রীর বিচারিক ও প্রশাসনিক নিয়তি বাংলাদেশের বিচারবিভাগ, প্রশাসন ও রাজনীতির বৈষম্য, ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ এবং আইনের প্রয়োগে নির্বাচনী মানদণ্ডের শক্ত উদাহরণ। একটি দেশে সরকার গঠনের সময় আইনের সীমা ও সমতা নীতি নিশ্চিত না হলে অপরাধে যুক্ত বা প্রতিক্রিয়াশীল—দু’পক্ষের আইন প্রয়োগই সময়ের হাতে ভিন্ন পরিণতি বয়ে আনে। গত দুই দশকের ঘটনাপ্রবাহ তারই নির্মম তথ্যচিত্র—বিচার ও প্রশাসনের ‘কামড়’ বা ‘ছায়া’ সব সময়ই ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১৩১ বার পড়া হয়েছে