বাংলাদেশে গুম: কে ফিরেছেন, কারা ফেরেননি, পরিবারের চাপা কান্না
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫ ১১:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে বিগত এক যুগে গুম শব্দটি এক ভয়াল বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। নিখোঁজ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে সরকারি কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই। অথচ পরিবারের বুকফাটা কান্না, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ-সব মিলিয়ে এক গভীর অন্ধকার অধ্যায়ের চিত্র আঁকে এই দেশ।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬০৪ জন মানুষকে গুম বা বাধ্য নিখোঁজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, আর মাত্র ৫৭ জন জীবিত ফিরে এসেছেন। অর্থাৎ নিখোঁজ হওয়া প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই আজও ফেরেননি বা চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
জাতিসংঘের Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances (WGEID)–এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০০৯–২০২২ সময়কালে অন্তত ৩৬৯ জন ফিরে এসেছেন, ৮১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, এবং ১৫৩ জন এখনো নিখোঁজ।
এই দুই সংস্থার তথ্যের তুলনা করলে স্পষ্ট হয়- ফিরে আসা'র গল্প আছে, কিন্তু তা সংখ্যায় ক্ষীণ; না ফেরার কাহিনি ঢেকে আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
রাজধানীর একটি এলাকায় বসে নিজের ভাইয়ের ছবি দেখাচ্ছিলেন শামীমা বেগম, যিনি ২০১৯ সালে নিখোঁজ হওয়া ছোট ভাই তৌহিদের খোঁজে বছরের পর বছর ধরে মানবাধিকার সংস্থার দ্বারে ঘুরছেন। তিনি বললেন, রাতে কালো পোশাক পরা কিছু লোক এসে চোখ বেঁধে নিয়ে গেল। এরপর আর কোনো খবর নেই। থানায় গেছি, কেউ মামলা নেয়নি। এখন শুধু অপেক্ষা, তার চোখে জল, কণ্ঠে কাঁপন। তৌহিদের মতো অগণিত পরিবার আজও অপেক্ষা করছে-কেউ জীবনের, কেউ অন্তত একটি খবরের জন্য।
যারা ফিরে এসেছেন, তাদের অধিকাংশই কথা বলতে চান না। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফিরে আসা ব্যক্তিদের অনেকে ভয়ে মুখ খুলেন না, কেউ বলেন বাইরে ছিলাম, কেউ বা একদমই জনসমক্ষে আসেন না। একজন ফেরত আসা ব্যক্তি গোপন শর্তে সাংবাদিককে বলেন- আমি জানি না কোথায় ছিলাম, কিছু মনে নেই। শুধু বলছি, এখন বেঁচে আছি, এটুকুই যথেষ্ট। এই নীরবতা হয়তো ভয় থেকে, অথবা এমন কোনো চুক্তির অংশ যা প্রকাশ্যে বলা যায় না।
সরকার সব সময় দাবি করে আসছে- বাংলাদেশে কোনো 'বাধ্য গুম' নেই; অনেক নিখোঁজ ব্যক্তি নিজেরাই পালিয়ে বিদেশে চলে যান বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব অজুহাতে রাষ্ট্রের দায় এড়ানো যায় না। Human Rights Watch ও Amnesty International বারবার বলেছে, বাংলাদেশে নিখোঁজের ঘটনা 'রাজনৈতিক দমননীতির অংশ হিসেবে ব্যবহার' করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ একাধিকবার বাংলাদেশ সরকারকে নিখোঁজের ঘটনার বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। ২০২২ সালে মার্কিন সরকার র্যাব ও তাদের কয়েক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যার অন্যতম কারণ ছিল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ। তবুও মাঠে-ঘাটে এখনো একই গল্প শোনা যায়- রাতের অন্ধকারে কেউ নিয়ে যায়, সকালে থাকে শুধু নীরবতা।
মানবাধিকার আইনজীবী সারা হক বলেন- বাংলাদেশে গুমের তদন্ত কার্যকর না হওয়ার প্রধান কারণ হলো-রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও বিচারহীনতা। ফিরে আসা ব্যক্তিরা যদি নিরাপদভাবে কথা বলতে পারতেন, অনেক সত্য প্রকাশ পেত।
আরেকজন বিশ্লেষক বলেন, এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রের উচিত নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা, যাতে প্রতিটি নিখোঁজের রহস্য উন্মোচিত হয়। গুম শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি গণতন্ত্রের মৃত্যুবার্তা।
বাংলাদেশের গুমের ইতিহাস এখন রক্তমাখা আর্কাইভে রূপ নিচ্ছে- যেখানে রয়েছে শত শত নাম, অগণিত কান্না, আর অনিশ্চয়তার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কে ফিরবেন, কে আর ফিরবেন না- এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অন্ধকারে ঢাকা।
১১৬ বার পড়া হয়েছে