বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রকৃতির ও মানবাত্মার নিবিড় কথাকার

বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়  এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র, যাঁর সৃজনশীলতা প্রকৃতি ও মানবাত্মার এক অবিচ্ছেদ্য এবং নিগূঢ় বন্ধনকে নিপুণভাবে উন্মোচন করেছে। 
তিনি কেবল একজন গল্পকার বা ঔপন্যাসিক ছিলেন না, ছিলেন এক দার্শনিক কবি, যাঁর লেখনীতে বিধৃত হয়েছে জীবন ও জগতের সুগভীর রহস্য, প্রকৃতির শাশ্বত রূপ এবং মানবচেতনার অন্তর্নিহিত স্পন্দন। নাগরিক জীবনের কোলাহল ও কৃত্রিমতা থেকে দূরে, মাটির কাছাকাছি এক সহজিয়া জীবনের প্রতিচ্ছবি তাঁর সাহিত্যে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যা পাঠককে এক চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বিভূতিভূষণের সাহিত্য নিছক গ্রামীণ জীবনের চিত্রায়ণ নয়, বরং তা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান প্রায়-আধ্যাত্মিক সম্পর্কের এক মহাকাব্য, যেখানে জড় ও চেতনের বিভেদরেখা প্রায়শই বিলীন হয়ে যায়।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যসত্তার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে প্রকৃতি। তাঁর লেখায় প্রকৃতি নিছক একটি পটভূমি বা অলংকারিক উপাদান নয়, বরং তা এক জীবন্ত, অনুভূতিশীল সত্তা – এক সক্রিয় চরিত্র যা কথা বলে, চরিত্রদের জীবনকে প্রভাবিত করে, তাদের মনোজগতে গভীর ছাপ ফেলে। এই প্রকৃতি কখনও মায়ের মতো আশ্রয় দেয়, কখনও প্রেমিকার মতো স্বপ্ন দেখায়, আবার কখনও বা রুদ্ররূপে নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটায়। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে নিশ্চিন্দিপুরের আমবাগান, বাঁশবন, ইছামতী নদী, ধানের খেত, এবং অসংখ্য বুনো ফুল ও লতাগুল্ম যেন অপু ও দুর্গার শৈশবের নিত্যসঙ্গী। এই প্রকৃতি কেবল তাদের খেলার মাঠ ছিল না, ছিল তাদের বিস্ময় ও কৌতূহলের উৎস, তাদের মনন গঠনের অন্যতম ভিত্তি। অপু ও দুর্গার শৈশবের অসংখ্য মুহূর্ত, বিশেষত রেলগাড়ি দেখার সেই অসামান্য অভিজ্ঞতা, প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে মানুষের অসীম জিজ্ঞাসাকে প্রতীকায়িত করে। রেলগাড়ি এখানে কেবল একটি যন্ত্র নয়, তা দূরের পৃথিবী, অজানার হাতছানি, যা প্রকৃতির বুক চিরে নবদিগন্তের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই চরিত্রদের সংবেদনশীলতাকে ধারালো করে তোলে, তাদের কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করে। আম-আঁটির ভেঁপু, টোপা কুড়ানো, বিলের ধারে কলমি শাক তোলা – এই সব আপাত সাধারণ ঘটনাগুলি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সংযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে। শৈশবের সেই অমেয় আনন্দ, প্রকৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের আবিষ্কার বিভূতিভূষণ এমন ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে, পাঠকও যেন সেই বিস্ময়ের ভাগীদার হয়ে ওঠে।
তাঁর প্রকৃতি-চেতনার চূড়ান্ত এবং পরিপক্ক রূপায়ণ ঘটেছে 'আরণ্যক' উপন্যাসে। এটি গতানুগতিক উপন্যাস নয়, বরং বিহারের লবটুলিয়ার গভীর অরণ্য-প্রান্তরের এক জীবন্ত ডায়েরি, এক আত্মজৈবনিক উপলব্ধি। এখানে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতি মানুষের আত্মাকে পরিশোধিত করে, কীভাবে তার আদিম, অকৃত্রিম সৌন্দর্য মানুষের ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। নগরজীবনের ধূসরতা ছেড়ে লবটুলিয়ার বিশাল অরণ্যানী, তার বুনো জীবন, সেখানকার সরল মানুষজন, বন্যপ্রাণী ও বিচিত্র উদ্ভিদরাজির সঙ্গে মিশে গিয়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যচরণ যেন নিজের সত্তাকে নতুন করে আবিষ্কার করে। অরণ্য এখানে একটি নিছক ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি এক মহাজীবনের প্রতীক, এক আধ্যাত্মিক আশ্রয় যেখানে মানুষ তার ক্ষুদ্র আমিত্ব ভুলে এক বৃহত্তর সত্তার সঙ্গে একাত্ম হতে শেখে। বিভূতিভূষণ 'আরণ্যক'-এ আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসী থাবা থেকে প্রকৃতির আদিম সৌন্দর্যকে রক্ষার এক আকুতিও ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে অরণ্য ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে মানুষের ভেতরের সহজ, সরল মানবিকতা। লবটুলিয়ার ধাতুরিয়া, রাজু পাড়ে, ভানুমতী, ধাওতাল সাহুদের মতো চরিত্রগুলি অরণ্যেরই অংশ, তাদের জীবনযাপন, প্রথা ও বিশ্বাস অরণ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তাদের মাধ্যমে লেখক অরণ্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং ধ্বংসের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিভূতিভূষণের কাছে প্রকৃতি শুধু সৌন্দর্যের আধার নয়, তা এক নৈতিক শিক্ষক, এক আধ্যাত্মিক গুরু, যা মানুষের আত্মাকে উচ্চতর উপলব্ধির দিকে ধাবিত করে।
তাঁর সাহিত্যের আরেকটি প্রধান সুর হলো 'যাত্রা' বা 'পথ'। বিভূতিভূষণের চরিত্ররা এক জায়গায় স্থির থাকে না; তারা অজানার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছাড়ে, পরিচিত পরিমণ্ডল ত্যাগ করে নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায়। এই যাত্রা কেবল ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, এ হলো মানসিক ও আত্মিক উত্তরণের এক অবিরাম প্রক্রিয়া। 'পথের পাঁচালী'-এর অপু গ্রামীন মায়া এবং নিশ্চিন্দিপুরের সরল জীবন ছেড়ে 'অপরাজিত' উপন্যাসে বৃহত্তর জীবনের পথে পা বাড়ায়। তার এই যাত্রা কেবল কলকাতা বা পাটনার দিকে নয়, এ হলো গ্রামীণ সরলতা থেকে শহুরে জীবনের জটিলতা, দুঃখ-কষ্ট, আর আত্ম-আবিষ্কারের পথে এক অবিরাম অভিযান। অপুর জীবন যেন এক অনন্ত পথিক, যার গন্তব্য স্থির নয়, বরং পথচলার মধ্যেই তার জীবনদর্শন নিহিত। সে সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রেম, বিরহ, দারিদ্র্য ও সাফল্য—সবকিছুর মধ্য দিয়ে এক অসীম জিজ্ঞাসায় তাড়িত হয়ে চলতে থাকে। বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করতেন, মানুষ মূলত এক 'পথিক' এবং জীবনের সার্থকতা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোতে নয়, বরং এই অবিরাম পথ চলার মধ্যেই নিহিত। এই দর্শন তাঁর অন্যান্য রচনাতেও মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিশোর উপন্যাস 'চাঁদের পাহাড়'-এর শঙ্কর চরিত্রের অ্যাডভেঞ্চার কেবল একটি রোমাঞ্চকর গল্প নয়, এটি তার অদম্য আত্মবিশ্বাস, অজানাকে জানার দুর্নিবার কৌতূহল এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের স্বপ্ন পূরণের এক মহাযাত্রা। আফ্রিকার অরণ্য ও পর্বতমালার গভীরে শঙ্করের এই যাত্রা যেন মানবাত্মার অদম্য শক্তি ও আবিষ্কারের নেশাকেই প্রতীকায়িত করে। 'আরণ্যক'-এর সত্যচরণও লবটুলিয়ার অরণ্যে এক ধরনের আত্মিক যাত্রাতেই লিপ্ত হয়, যা তাকে নগরজীবনের শুষ্কতা থেকে মুক্তি দিয়ে এক গভীরতর সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এই 'পথ' বা 'যাত্রা' বিভূতিভূষণের সাহিত্যের এক মৌলিক কাঠামো, যা চরিত্রদের জীবনকে গতিশীলতা দান করে এবং তাদের আত্মিক বিকাশকে সম্ভব করে তোলে।
বিভূতিভূষণের গদ্যশৈলী সহজ, সরল অথচ গভীর কাব্যময়। তিনি ভাষার আড়ম্বর বা জটিল তত্ত্বকথা প্রচার করেননি, বরং সাধারণ মানুষের জীবনের ছোট ছোট আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা এবং প্রকৃতির সূক্ষ্ম সৌন্দর্যকে অসামান্য মমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর ভাষা যেন নিরাভরণ গ্রাম্য প্রকৃতির মতোই অকৃত্রিম এবং প্রাণবন্ত। তাঁর বাক্যগঠন সাবলীল, বর্ণনা সুচারু এবং উপমাগুলি প্রকৃতির গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে উৎসারিত। এই গদ্যের মাধ্যমেই তিনি পাঠককে এক মায়াবী জগতের অভ্যন্তরে নিয়ে যান, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি অনুভূতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিভূতিভূষণের চরিত্ররা—তা সে 'পথের পাঁচালী'র সর্বজয়া হোক বা 'আরণ্যক'-এর ধাতুরিয়া—সকলেই অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু লেখকের গভীর সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা ও জীবনবোধের ছোঁয়ায় তারা অসাধারণ হয়ে উঠেছে। তিনি তাদের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-ভঙ্গ, সরলতা ও জটিলতাকে এত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন যে তারা পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করে। সর্বজয়ার দারিদ্র্য, তার সন্তানদের প্রতি মমত্ববোধ, তার স্বপ্ন ও হতাশা—এসবই বিভূতিভূষণের লেখনীতে এক শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। তিনি দারিদ্র্যকে মহিমান্বিত করেননি, কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্যেও মানুষের আত্মমর্যাদা ও বেঁচে থাকার আনন্দকে সম্মান জানিয়েছেন। তাঁর চরিত্রগুলি কখনো তথাকথিত 'হিরো' হয় না, তারা যেন আমাদেরই পাশের বাড়ির মানুষ, যাদের জীবনযাপনে আমরা খুঁজে পাই নিজেদেরই প্রতিচ্ছবি। বিভূতিভূষণ এই সাধারণ মানুষের জীবনের গভীরে প্রবেশ করে তাদের আত্মিক সমৃদ্ধি ও প্রকৃতির সঙ্গে তাদের হার্দিক সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন।
বিভূতিভূষণের সাহিত্য কেবল গ্রামীণ জীবনের দর্পণ নয়, তা মানব প্রকৃতির এক অবিরাম অনুসন্ধান। তাঁর লেখায় গ্রাম ও শহরের ভেদরেখা প্রায়শই মুছে যায়, কারণ তিনি মূলত 'মানুষের' কথা বলেছেন, সেই মানুষের কথা যা ভৌগোলিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক শাশ্বত মানবাত্মার রূপ ধারণ করে। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগুলিতে এক গভীর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে মানুষের মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি অরণ্যের আদিবাসী, নিঃস্ব গ্রামবাসী বা শহরের বোহেমিয়ান—সবার মধ্যেই এক চিরন্তন মানবিক সংবেদনশীলতা খুঁজে পেয়েছেন। বিভূতিভূষণের রচনার মূল সুর হলো এক অদম্য জীবনতৃষ্ণা, এক অপার বিস্ময়বোধ এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক অন্তর্নিহিত বাসনা। তাঁর সাহিত্য পাঠ করে পাঠক কেবল আনন্দ পায় না, বরং এক ধরনের মানসিক শান্তি ও আত্মিক তৃপ্তি লাভ করে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি এমন এক সাহিত্যিক ধারা তৈরি করেছেন যা জীবনের সহজতা, প্রকৃতির মহিমা এবং মানবাত্মার অন্তর্নিহিত শক্তিকে উদযাপন করে। তাঁর সাহিত্য চিরকাল বাঙালির মননে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকবে। যতদিন বাঙালি তার শিকড়ের টান অনুভব করবে, যতদিন প্রকৃতির মাঝে অপার বিস্ময় খুঁজে পাবে এবং যতদিন মানবাত্মার অদম্য যাত্রাকে সম্মান জানাবে, ততদিন বিভূতিভূষণ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তিনি কেবল একজন ঔপন্যাসিক নন, তিনি বাঙালির শাশ্বত স্মৃতির রূপকার, যিনি তাঁর শব্দবন্ধে বেঁধে রেখে গেছেন এক অনুপম জীবনদর্শন, যা প্রকৃতি ও মানবাত্মার নিবিড় কথামালায় চিরভাস্বর। তাঁর সাহিত্য শুধু অতীতের কথা বলে না, তা ভবিষ্যতের পথও নির্দেশ করে, এক চিরন্তন সৌন্দর্য ও শান্তির বার্তা বহন করে আনে। তাঁর লেখনীতে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে, যা বাংলা সাহিত্যকে এক গভীর দার্শনিক উচ্চতায় উন্নীত করেছে। বিভূতিভূষণের শিল্পকর্ম যেন এক অনন্ত বটের ছায়ার মতো, যা ক্লান্তি দূর করে এবং জীবনের পথে অগ্রসর হতে নতুন প্রেরণা যোগায়।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা। 
১৯১ বার পড়া হয়েছে