ঢাকার ডেমরার নিউ টাউন সোসাইটি উন্নয়ন প্রকল্পে সিডরোর সার্বিক সহায়তা
বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ ৭:১৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
রাজধানী ঢাকার প্রান্তিক এলাকা ডেমরা। দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের অনেক আবাসিক সোসাইটি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। অবকাঠামোগত দুরবস্থা, নোংরা ড্রেন, অপরিষ্কার রাস্তাঘাট, মশা ও আবর্জনার উপদ্রব—এসব সমস্যাই ছিল বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী।
কিন্তু সম্প্রতি ডেমরার নিউ টাউন সোসাইটিতে শুরু হয়েছে একটি পরিবর্তনের ধারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে, এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিডরো (SEDRO)-এর সার্বিক সহযোগিতায় সোসাইটির উন্নয়ন কার্যক্রম ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
উন্নয়নের সূচনা: নাগরিক উদ্যোগ ও বেসরকারি সহযোগিতা-নিউ টাউন সোসাইটির বাসিন্দাদের দাবি, অনেক বছর ধরে তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি জানালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ২০২৪ সালের শেষের দিকে, স্থানীয় কয়েকজন তরুণ সমাজকর্মীর উদ্যোগে সোসাইটির সমস্যা চিহ্নিত করা হয় এবং তা নিয়ে গঠন করা হয় “নিউ টাউন সোসাইটি উন্নয়ন কমিটি”। তাদের এই নাগরিক প্রচেষ্টার সঙ্গী হয় বেসরকারি সংস্থা সিডরো, যারা নগর পরিকল্পনা, পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করে আসছে।
সিডরোর একজন প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, “আমরা নিউ টাউন সোসাইটিতে একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে কাজ শুরু করি। লক্ষ্য ছিল—নাগরিকদের নিজেদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।”
রাস্তাঘাট মেরামত ও অবকাঠামো সংস্কার-প্রথম ধাপে সোসাইটির সবচেয়ে জরুরি কাজ হিসেবে ধরা হয় রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারকে। সিডরোর সহায়তায় স্থানীয় শ্রমিক ও যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় স্বেচ্ছাসেবী টিম।
দেড় মাসের মধ্যেই ১.২ কিলোমিটার ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামত করা হয়, পাশাপাশি ৩টি মূল ড্রেন পরিষ্কার ও নতুন ঢাকনা বসানো হয়। এতে বৃষ্টির পানি জমে থাকার সমস্যা অনেকটাই দূর হয়েছে।
অত্র এলাকার একজন বাসিন্দা মো: শামীম আহমদ বাবু বলেন, “বছরের পর বছর এখানে হাঁটাচলা করা মুশকিল ছিল। বৃষ্টিতে কাদা আর ড্রেনের পানি ঘরে ঢুকে যেত। এখন রাস্তা সমান, পানি জমে না—এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পরিবর্তন।”
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধন অভিযান
অবকাঠামো সংস্কারের পর দ্বিতীয় ধাপে সোসাইটিতে শুরু হয় পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সিডরো প্রতি সপ্তাহে একটি করে ‘কমিউনিটি ক্লিনিং ডে’ চালু করে। স্থানীয় নারী-পুরুষ ও কিশোররা এতে অংশ নেয়। আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় প্লাস্টিক ও জৈব বর্জ্য আলাদা করার নিয়ম চালু হয়।
এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় শুরু হয় মশা নিধন কার্যক্রম। সিডরোর উদ্যোগে সংগ্রহ করা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধ। গত তিন মাসে সোসাইটিতে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ৭০% পর্যন্ত কমে এসেছে বলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন।
সবুজায়ন ও নাগরিক সচেতনতা
শুধু রাস্তা বা ড্রেন নয়, পরিবেশ রক্ষায়ও নেওয়া হয়েছে কার্যকর পদক্ষেপ। সিডরোর সহায়তায় সোসাইটির প্রায় ২০টি রোডের দুই পাশে ২৫০টি ফলজ ও বনজ গাছ রোপণ করা হয়েছে।
সোসাইটির উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মো:জসিম উদ্দিন সিকদার বলেন, “আগে এখানে শুধু ধুলা ও আবর্জনা দেখা যেত, এখন সকালে পাখির ডাক শোনা যায়। আমরা চাই এই সবুজায়ন ধরে রাখতে সবাই নিজের দায়িত্ব বুঝুক।”
সিডরোর ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা-সিডরোর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, বরং নাগরিকদের মধ্যে মালিকানা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করা। নিউ টাউন সোসাইটি এখন একটি মডেল হতে পারে, যেখানে সরকারি সহযোগিতা ছাড়াও স্থানীয় উদ্যোগেই উন্নয়ন সম্ভব।”
তিনি জানান-পরবর্তী ধাপে সোসাইটিতে একটি কমিউনিটি হেলথ কর্নার, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার কেন্দ্র এবং নাগরিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দারা এখন গর্বের সঙ্গে বলেন, “নিউ টাউন বদলে যাচ্ছে।” আগে যেখানে অপরিকল্পিততা ও অব্যবস্থাপনা ছিল, এখন সেখানে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের ছোঁয়া।
গৃহিণী তাসমিনা এনাম তৃনা বলেন, “আমরা ভাবিনি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় এত পরিবর্তন সম্ভব। এখন বুঝি, ইচ্ছা থাকলে জনগণ নিজেরাই তাদের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে।”
ডেমরার নিউ টাউন সোসাইটির এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে—শুধু সরকারি বরাদ্দ নয়, নাগরিক উদ্যোগ ও বেসরকারি সহযোগিতাই হতে পারে নগর উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। সিডরোর মতো সংগঠন যদি দেশের অন্যান্য আবাসিক এলাকাগুলোকেও একইভাবে সহায়তা করে, তবে ঢাকার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোও হতে পারে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও মানবিক শহুরে জীবনের অংশ।
১১৮ বার পড়া হয়েছে