চাকমা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মুসলিম কালচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:১৯ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এমন এক ভূগোল যেখানে পাহাড়, নদী, বন, এবং মানুষের জীবন একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
এই অঞ্চল কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্যও একটি জীবন্ত ঐতিহাসিক ক্ষেত্র। এখানে ১১টিরও বেশি নৃগোষ্ঠী বসবাস করে, যার মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় সংখ্যায় সর্বাধিক ও শিক্ষা, কৃষ্টি-কালচারে অগ্রগামী।
Bangladesh Bureau of Statistics-এর (২০২২ সালের আদম শুমারি ও গৃহসিযুক্তি জরিপ) প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, বিশুদ্ধ “ছোট জাতি/উপজাতি” (indigenous peoples / small ethnic groups) হিসেবে গণ্য হয় এমনদের সংখ্যা প্রায় ১,৬৫০,১৫৯ জন (দেশের মোট জনসংখ্যার ১.০০ %)।
২০১১ সালে আদম শুমারি অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ছিল প্রায় ১,৫৮৬,১৪১ জন, যা দেশ জনসংখ্যার ১.১০ % ছিল।
তবে আদিবাসী সংগঠন বা বিভিন্ন গবেষকরা দাবি করেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংখ্যাটি অনেক বেশি — অর্থাৎ ৩–৪ মিলিয়নের (৩০–৪০ লাখ) মধ্যে হতে পারে। চাকমা সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৪,৮৩,২৯৯ জন (২০২২) – আদিবাসী জনসংখ্যার মধ্যে ২৯.২৯ % ভাগ। মার্মা সম্প্রদায়ের সংখ্যা ২,২৪,২৬১ জন (২০২২) – ১৩.৫৯ % ভাগ। তঞ্চাঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৪৫,৯৭২ জন (২০২২) – ২.৭৯ % ভাগ।
যদিও চাকমারা ধর্মীয়ভাবে থেরবাদী বৌদ্ধ, তবু ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ এক বিশেষ আলোচনার বিষয়। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানের পেছনে রয়েছে কয়েক শতাব্দীর যোগাযোগ, বাণিজ্য, সুফি প্রভাব ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ধারাবাহিক ইতিহাস—যা বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির অন্যতম দৃষ্টান্ত।
চাকমা সম্প্রদায় মূলত থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বুদ্ধের “অষ্টাঙ্গিক মার্গ” ও “চার আর্যসত্য” তাদের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। তারা বিশ্বাস করে—লোভ, ক্রোধ ও মোহ থেকে মুক্তিই নির্বাণের পথ। চাকমাদের ধর্মীয় উৎসব যেমন বৈসাখী পূর্ণিমা (বুদ্ধপূর্ণিমা), মাঘ পূর্ণিমা ও ওয়াগা পয় (কাথিন চীবর দান) ইত্যাদি মানবিক সহানুভূতি, অহিংসা ও দানবোধের ওপর বিশেষ জোর দেয়।
তবে চাকমা সমাজে ধর্মীয় জীবন কেবল মঠ বা “কিয়ং”-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লোকবিশ্বাসে আত্মা, প্রকৃতি ও “নাত দেবতা”-র পূজার প্রচলন আছে। সমাজবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ (২০১৯, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি) লিখেছেন—
“চাকমা ধর্মবিশ্বাসের ভেতরে বৌদ্ধ নীতিবোধের পাশাপাশি প্রাচীন আর্যোত্তর লোকবিশ্বাসের সমন্বয় দেখা যায়, যা তাদের মানবিকতা ও ধর্মীয় সহনশীলতাকে গভীর করেছে।”
এই ধর্মীয় সহনশীলতা পরবর্তীতে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার সামাজিক মনোভাব তৈরি করেছে। চাকমাদের ইতিহাস আরাকান ও আসাম অঞ্চলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ১৬শ শতাব্দীতে তারা আরাকানের রাজ্যের প্রভাবাধীন ছিল, যেখানে মুসলিম প্রশাসক, সৈনিক ও সুফি সাধকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার (1876, A Statistical Account of Bengal) উল্লেখ করেন যে—আরাকান ও চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকায় মুসলিম ব্যবসায়ী ও সুফি ধর্মপ্রচারকদের আগমন চাকমা রাজ্যেও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
চট্টগ্রামের মুঘল প্রশাসনের সময় (১৭শ–১৮শ শতাব্দী) চাকমা রাজারা—বিশেষ করে রাজা জণবক্স খা ও বীর রাজা—মুসলিম শাসকদের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাঁরা মুঘল প্রশাসনের করদ রাজা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। এই রাজনৈতিক সম্পর্ক সামাজিক যোগাযোগেরও পথ খুলে দেয়। ফলে বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী ও সুফি দরবেশরা পাহাড়ি অঞ্চলে যাওয়া-আসা করতেন, এবং চাকমা সমাজের অনেকেই তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও মানবিক উপদেশে প্রভাবিত হন।
চাকমা ধর্মবিশ্বাস ও সুফি ইসলাম—দুটি দর্শনের মধ্যে মৌলিক মিল রয়েছে। উভয়ই আত্মার পরিশুদ্ধি, অহিংসা ও মানবপ্রেমকে ধর্মের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বলে মানে। ইমাম আল-গাজ্জালী (রহ.) তাঁর ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন-এ লিখেছেন—“মানুষ যদি নিজের অন্তরের অহংকারকে দমন করতে পারে, তবেই সে আল্লাহর নৈকট্য পেতে পারে।” অন্যদিকে, বুদ্ধের বাণীতে বলা হয়—“মনই সকল কর্মের মূল; মন যদি বিশুদ্ধ হয়, কর্মও বিশুদ্ধ হয়।” এই দুই শিক্ষার মূলে রয়েছে আত্মসংযম, দয়া ও পরম সত্যের অন্বেষা। এজন্য সুফিবাদ ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন তৈরি হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে।
UNDP-এর Cultural Diversity and Social Cohesion in the CHT (2020) প্রতিবেদনে বলা হয়—চাকমা সমাজে ইসলামী সংস্কৃতি, বিশেষ করে সুফি ভাবধারার প্রভাব দৃশ্যমান। বৌদ্ধ অহিংসা ও সুফি মানবপ্রেম—এই দুইয়ের মেলবন্ধন স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। চাকমা সমাজ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখায়। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, এমনকি রমজান মাসে মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে তারা সৌজন্য বিনিময় করে। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির অনেক এলাকায় স্থানীয় বাজারে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চাকমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধ ধর্মের মেত্তা ভাবনা (Loving-kindness Meditation) যেমন সকল প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়, ইসলামের শিক্ষাও তেমনি বলে—
“যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।” (সহিহ বুখারী, হাদিস ৬০১৩) এই দুই দর্শনের নৈতিক সংযোগই চাকমা-মুসলিম পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি। চাকমা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে—“পাহাড়ে বুদ্ধ, সমতলে আল্লাহ”—যা তাদের ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রতীকী প্রকাশ।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই নীতি পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীগুলোর ধর্মীয় সহাবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। রাঙামাটি সরকারি কলেজ ও বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ড. নুসরাত রহমান (২০২১, Journal of Ethno-Religious Studies) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়—চাকমা ও মুসলিম শিক্ষার্থীরা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে অংশ নেয় এবং উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সাংস্কৃতিক কৌতূহল বিদ্যমান। এই প্রজন্মভিত্তিক সহাবস্থানই ভবিষ্যতের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির পথ নির্মাণ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ একাধিকবার আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করেছে। এসব আলোচনায় বৌদ্ধ ভিক্ষু, মুসলিম আলেম ও স্থানীয় সমাজনেতারা একমত হয়েছেন যে—মানবতা, দয়া ও ন্যায়বোধ হচ্ছে সকল ধর্মের মূল। ২০২২ সালের এক সভায় রাঙামাটির ভিক্ষু ভান্তে উপজ্যোতি মহাথেরো বলেন—
“ইসলাম যেমন শান্তির ধর্ম, তেমনি বৌদ্ধ ধর্মও শান্তির পথ। আমরা ভিন্ন পথে চললেও লক্ষ্য এক—মানবতার কল্যাণ।”
এমন বক্তব্যগুলো চাকমা সমাজের ইসলামের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবকে প্রতিফলিত করে।
চাকমা সংগীত, পোশাক ও নৃত্যে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবও স্পষ্ট। ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতিন ও সিলাই থামপন এখন মুসলিম নকশাকারদের তৈরি সুতা ও অলঙ্করণে নতুন রূপ পেয়েছে। একইভাবে মুসলিম সমাজেও চাকমা বৈসাবি উৎসবের আনন্দে অংশ নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই পারস্পরিক মেলবন্ধনকে “সাংস্কৃতিক সহাবস্থান” (Cultural Symbiosis) বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো একে অপরের সংস্কৃতি গ্রহণ করে কিন্তু নিজস্ব পরিচয় হারায় না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছ —“প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার থাকবে।” এই সাংবিধানিক নিশ্চয়তার বাস্তব রূপ সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির ইতিহাস (২০১৮) গ্রন্থে বলা হয়েছে—চাকমা ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা বাংলাদেশের বহুত্ববাদী সমাজগঠনের অন্যতম শক্তি। এই সহনশীলতা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং মানবিক ও নৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন।
চাকমা সম্প্রদায় ধর্মীয়ভাবে বৌদ্ধ হলেও, তাদের মননে ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। এই শ্রদ্ধা ইতিহাস, সুফি প্রভাব, মানবিক আচরণ ও সামাজিক যোগাযোগের এক সম্মিলিত ফল। বিশ্ব যখন ধর্মীয় বিভাজন ও সহিংসতার জ্বরে আক্রান্ত, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা-মুসলিম সম্পর্ক আমাদের শেখায়—ধর্মের মূল শিক্ষা হলো মানবতার সেবা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও নৈতিক সহাবস্থান।
ইসলাম যেমন বলে— “লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।” (সূরা আল-কাফিরুন, আয়াত ৬) অর্থাৎ, তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।
অন্যদিকে বুদ্ধের উপদেশ— “সব জীবের প্রতি করুণা দেখাও; কারণ প্রত্যেকেই দুঃখ থেকে মুক্তি চায়।” এই দুই মহান বাণীর সংলগ্নতাই বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির সত্যিকার ভিত্তি, এবং চাকমা সমাজ তার এক জীবন্ত উদাহরণ।
তথ্যসূত্র:
১. ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ২০১৯
২. ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির ইতিহাস, ২০১৮
৩. UNDP, Cultural Diversity and Social Cohesion in the CHT, ২০২০
৪. Prof. Mizanur Rahman, Ethno-Religious Harmony in the Chittagong Hill Tracts, Journal of South Asian Studies, Vol. 18, 2021।
৫. William Hunter, A Statistical Account of Bengal, Vol. VI, London, 1876।
৬. Dr. Nusrat Rahman, Interfaith Education in the CHT, Journal of Ethno-Religious Studies, 2021
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্রাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।
১২০ বার পড়া হয়েছে