সর্বশেষ

সাহিত্য

জীবনানন্দ দাশ: আধুনিক বাংলা কবিতার অন্তর্নিহিত যাদুকর ও প্রকৃতির চিরন্তন গায়ক

গাউসুর রহমান 
গাউসুর রহমান 

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:৩৬ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জীবনানন্দ দাশ এক অদ্বিতীয় পরিচয় নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়ামুক্ত হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন পথ রচনা করে গেছেন।

তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, ইতিহাস, স্মৃতি ও মানবিক একাকিত্বের জটিল সমন্বয় এমন এক অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে, যা শুধু তাঁর সমকালীন পাঠকদের কাছেই নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিক-সমালোচকদের মধ্যেও অক্ষয় প্রভাব রেখেছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে জীবনান্দকে একজন ‘বিলুপ্ত যুগের কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, তাঁর কাব্যভাষ্য ও প্রতীকী ব্যঞ্জনার গভীরতা আজও নতুন নতুন অর্থবোধের সন্ধান দেয়। তাঁর সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পল্লীজীবন, নদী-বন-খরস্রোত, এবং মানবাত্মার নিঃসঙ্গ অনুসন্ধান এক অপ্রতিরোধ্য সংগীতে পরিণত হয়েছে। 

 

জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি শুধু পটভূমিকা নয়, এক জীবন্ত সত্তা, যা মানব অস্তিত্বের আবেগ ও চিন্তাকে প্রতিধ্বনিত করে। তাঁর কাছে বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যমালা এক পৌরাণিক রূপ পেয়েছে, যেখানে নদী হয়ে ওঠে ‘অনন্ত কালের স্মৃতি’, আর বন পরিণত হয় অতীতের গোপন ইতিহাসে। কবিতা ‘রূপসী বাংলা’-তে তিনি লিখেছেন, “কোথাও বা দেখি নদীর ধারে / ধান্যক্ষেত্রে মেঘের আঁচল / হাওয়া যেন টেনে নিয়ে যায় / এক অজানা দেশের পথে।” এখানে মেঘের আঁচল ও হাওয়ার মাধ্যমে প্রকৃতি শুধু দৃশ্যমান নয়, বরং এক অদৃশ্য যাত্রার প্রতীক হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের প্রকৃতি কখনো স্থির নয়, এটি সঞ্চালিত, চঞ্চল, এবং মানব জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কবিতা ‘মাধুকরী’-তে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মানব সম্পর্ককে এক অধ্যাত্মিক সন্ধানে রূপ দিয়েছেন: “তোমার হাতের মাঝে একটি ফুল আমি / আজও খুঁজি, খুঁজি আকাশে চাঁদে তারায়।” এই পংক্তিগুলিতে প্রকৃতির উপাদান—ফুল, আকাশ, চাঁদ—মানব আকাঙ্ক্ষার প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে, যা ট্যাগোরের ‘প্রকৃতি-ভক্তি’ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রায়শই দার্শনিক সুরে উপলব্ধি করা হয়েছে, কিন্তু জীবনানন্দের প্রকৃতি ‘অনুভূতির ভাষা’, যা অবচেতন মনের গূঢ় স্তরকে স্পর্শ করে। সমালোচক ক্লিনটন সিলি তাঁর Jibanananda Das: A Critical Biography গ্রন্থে এই দিকটি স্পষ্ট করেছেন, যে জীবনানন্দের প্রকৃতি দর্শন ‘রোমান্টিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা নয়, বরং মডার্নিজমের প্রথম নিঃশ্বাস’।

 

সময় ও ইতিহাসের প্রতি জীবনানন্দের অনুভূতি তাঁর কবিতাকে এক দার্শনিক গভীরতা দান করেছে। তাঁর মতে, সময় এক নিরন্তর প্রবাহ, যা মানব জীবনকে আবর্তিত করে, কিন্তু সেই আবর্তনের মধ্যেও লুকিয়ে আছে অমরত্বের সন্ধান। কবিতা ‘মহাপৃথিবী’-তে তিনি সময়কে এক বিশাল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন: “মানুষ যে কী প্রাণী, কালো ঘোড়া নাকি পাখি? / কত সভ্যতা ভেঙেছে, কত সমুদ্র হেরেছি / কত নদীর তীরে আমি বসে আছি একা!” এই পংক্তিগুলিতে সময়ের বিশালতা ও মানব অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা একসাথে ধ্বনিত হয়েছে। জীবনানন্দের সময় রৈখিক নয়; এটি এক বৃত্তাকার প্রবাহ, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরস্পরের সাথে মিশে আছে। এই দর্শন তাঁর কবিতায় এক ভবিষ্যদ্বাণীময় স্বর যোগ করেছে। সমালোচক পার্থ ভট্টাচার্য তাঁর জীবনানন্দ দাশ: কবি ও কাল (২০০৫) গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, জীবনানন্দের সময় ধারণা ‘হেইডেগারের Being and Time-এর প্রভাবের চেয়েও বেশি প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে কাল অনন্ত ও চক্রাকার’। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতায় এক অনন্ত অনুসন্ধানের ছাপ রেখেছে, যেখানে মানুষ সময়ের সাথে সংগ্রাম করে না, বরং তার সাথে একাত্ম হয়ে ওঠে।

 

জীবনানন্দের কবিতায় মানবিক একাকিত্ব ও অস্তিত্বের বিষাদ এক কেন্দ্রীয় থিম। তাঁর কবিতা ‘বনলতা সেন’ এই বিষয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যেখানে এক যাত্রীর দীর্ঘ পথচলা ও সন্ধান মানব জীবনের নিঃসঙ্গ অভিযানকে নির্দেশ করে। “আমি আসিনি পথ হতে ভুলে, / ভুলে যাওয়া পথ ধরে চলেছি / নানা দেশে কালে— / কোনো দিন রাত্রি কোথাও কাটেনি / এই দু’টি হাতের মাঝে।” এই পংক্তিগুলিতে পথিকের অস্তিত্বগত শূন্যতা ও প্রেমের অনুসন্ধান এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক স্তর প্রকাশ করে। বনলতা সেন শুধু এক নারী নয়, বরং অবিনাশী শান্তির প্রতীক, যা মানুষের চিরন্তন স্বপ্ন। কবি এখানে সমস্ত ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পটভূমিকা পেরিয়ে এক মৌলিক মানবিক অনুভূতিতে পৌঁছেছেন। এই বিষয়ে সমালোচক সুকুমার সেন তাঁর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, “জীবনানন্দের নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথের ‘বিষাদ-সল্পতা’ নয়, এটি এক আধুনিক মানুষের অস্তিত্বগত দ্বন্দ্ব, যা যুদ্ধোত্তর বিশ্বের প্রতিফলন।” বিশেষ করে ১৯৪০-এর দশকে, যখন বিশ্বযুদ্ধ ও বাংলার অকাল মন্বন্তর মানব সমাজকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, জীবনানন্দের কবিতা সেই যন্ত্রণার গূঢ় অনুভূতিকে কবিতার সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করেছে।

জীবনানন্দের ভাষা ও কাব্যিক গঠন তাঁকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি ছন্দবদ্ধ পদ্যের পরিবর্তে মুক্তছন্দের প্রয়োগ করেছেন, যেখানে দীর্ঘ পংক্তি ও অপ্রত্যাশিত অলংকার এক অদ্ভুত সংগীতধর্মিতা সৃষ্টি করে। কবিতা ‘শাদু মেয়ে’-তে তিনি লিখেছেন, “শাদু মেয়ে আমার চোখের সামনে / সোনালী ধানের ক্ষেত থেকে উঠে এল / পায়ের নুপুর বাজায়ে— / আমি তার চোখে দেখলাম সমুদ্রের নীল আভা!” এখানে ‘সোনালী ধান’ ও ‘সমুদ্রের নীল আভা’-র মতো অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি প্রতীকী ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ করেছেন। জীবনানন্দের কবিতায় প্রায়ই দেখা যায়, স্থান ও সময়ের সীমানা মুছে যায়, এবং বাস্তব ও স্বপ্নের মধ্যে এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটে। এই কৌশল তাঁর কবিতাকে সুরেয়ালিস্ট রূপ দিয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে পূর্বে অপ্রচলিত ছিল। সমালোচক অমিতাভ ঘোষ তাঁর জীবনানন্দ দাশ: এক পুনর্মূল্যায়ন (২০১০) গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “জীবনানন্দের ভাষা এক অদৃশ্য নদীর মতো—কখনো স্পষ্ট, কখনো আবছা, কিন্তু সবসময় গভীর।” এই ভাষাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রাথমিকভাবে তাঁর পাঠকদের কাছে অপ্রিয় হলেও, পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা—যেমন শঙ্খ ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ—এই ধারাকে অনুসরণ করেছেন।

 

জীবনানন্দের প্রতি সমসাময়িক সমালোচনা ছিল বিভাজিত। বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক (১৯২৭)-এর সমালোচনায় লিখেছিলেন, “জীবনানন্দের কবিতা অস্পষ্ট, এটি পাঠককে বিভ্রান্ত করে।” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই অস্পষ্টতাই তাঁর কাব্যের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর—বিশেষ করে ১৯৫০-৬০-এর দশকে—জীবনানন্দের পুনরুদ্ধার ঘটে, যখন তরুণ পাঠকরা তাঁর কবিতায় নতুন অর্থ খুঁজে পেতে শুরু করে। এই পুনরুদ্ধারের পেছনে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের তরুণ কবিরা, যারা জীবনানন্দের প্রকৃতি-চিত্রণ ও মানবিক সন্ধানকে তাদের স্বাধীনতার আবেগের সাথে যুক্ত করেছিলেন। কবি আল মাহমুদ তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন, “জীবনানন্দ ছিলেন এমন এক কবি, যার কবিতা পড়লে মনে হয়, বাংলা ভাষা নিজেই কথা বলছে।” আজ জীবনানন্দের কবিতা বাংলা ভাষার অংশবিশেষ হয়ে গেছে; ‘বনলতা সেন’ বা ‘রূপসী বাংলা’ শুধু কবিতা নয়, এক সাংস্কৃতিক প্রতীক।

 

জীবনানন্দের কবিতা আধুনিকতার সন্ধানে গেলেও, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গভীরভাবে বাংলার মাটি ও জলের সঙ্গে জড়িত। তিনি ইউরোপীয় মডার্নিজমের প্রভাব নিলেও, তাঁর কাব্যভাষ্য সম্পূর্ণরূপে বাংলার সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। কবিতা ‘দুই একটি কবিতা’-তে তিনি লিখেছেন, “এই যে আমি আসি নিরুদ্দেশ হতে, / মাটির গন্ধে ভরা হাওয়া আমার শিরে— / মানুষ যে কী প্রাণী, বুঝি না, / কিন্তু মাটির গন্ধ আমায় ডাকে!” এখানে ‘মাটির গন্ধ’ বাংলার সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে নির্দেশ করে, যা তাঁর কাব্যের মূল স্পন্দন। এই স্থানীয়তা তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের মাপকাঠিতেও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। 

 

জীবনানন্দ দাশের কাব্যজগৎ শুধু পদ্যরচনার ক্ষেত্রে নয়, বরং বাংলা ভাষার সম্ভাবনা বিস্তারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর ব্যবহৃত শব্দচয়ন—যেমন ‘নীলিমা’, ‘স্মৃতিছায়া’, ‘অন্ধকারের রেশ’—আজ বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী শব্দভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। তাঁর কবিতায় প্রায়ই দেখা যায়, সাধারণ শব্দকে অসাধারণ অর্থে ব্যবহার করে তিনি ভাষাকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। কবিতা ‘মাধুকরী’-তে “আমি খুঁজি তোমার চোখের গভীরে / সেই ফুলটি, যা ফোটে নি কখনো”—এই পংক্তিতে ‘ফুল’ শব্দটি শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই ভাষাগত সৃজনশীলতা তাঁর কবিতাকে সময়ের ঊর্ধ্বে স্থাপিত করেছে। সমালোচক সজল দত্ত জীবনানন্দ: ভাষা ও ব্যঞ্জনা  গ্রন্থে লিখেছেন, “জীবনানন্দ বাংলাকে এক নতুন শ্বাস দিয়েছেন, যা আগে কল্পনাও করা যায়নি।”

 

জীবনানন্দ দাশের কাব্যিক উত্তরাধিকার বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় চিহ্ন রেখেছে। তাঁর কবিতা আধুনিক মানুষের অস্তিত্বগত প্রশ্নের উত্তর দেয় না, বরং সেই প্রশ্নগুলিকে কাব্যের মহিমায় মণ্ডিত করে। তাঁর প্রতিটি কবিতা এক অন্বেষণ, যেখানে প্রকৃতি, সময় ও মানব হৃদয়ের গূঢ় সম্পর্ক উন্মোচিত হয়। জীবনানন্দ শুধু কবি নন, তিনি বাংলা ভাষার এক যাদুকর, যিনি শব্দের মাধ্যমে অমরত্বের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কবিতার শেষ পংক্তি—“আমি আসব আবার, বনলতা সেনের দেশ থেকে”—এই অপেক্ষার প্রতীক, যে কবিতা শেষ হয় না, বরং অনন্তকালের জন্য জীবিত থাকে। জীবনানন্দের এই অনন্ত প্রত্যাবর্তনই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাণবন্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।


লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা। 

১৮৭ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন