সর্বশেষ

মতামত

নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা: জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রেক্ষাপট

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ ৩:৪০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজন স্বীকৃত ও জনবহুল "দি ল্যানসেট" জার্নাল বাংলাদেশের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জরুরি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করছে এভাবে- Eemphasizing the profound impact of climate-related shocks, such as flooding, on women's food security and psychological well-being.

A study in rural Sylhet revealed that unseasonable flooding significantly affected women's mental health, yet few received formal mental health support. This underscores the necessity for integrating mental health services into disaster response strategies and enhancing access to care for women in vulnerable communities.

নারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মধ্যে গভীর ও পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (MDG) লক্ষ্য-৫ নারীদের স্বাস্থ্য ও প্রজনন অধিকার সুরক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সন্তান ধারণের বয়সে নারীরা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বিষণ্নতায় ভোগেন—যা একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজননস্বাস্থ্য, দাম্পত্য সম্পর্ক ও নবজাতকের আচরণসহ নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের নিয়মিত মূল্যায়ন অপরিহার্য।

আমি কোনো চিকিৎসক বা ফিজিশিয়ান নই, তবু দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি—স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল অন্তর্গত অঙ্গসংস্থানবিদ্যা (Anatomy) ও শারীরবৃত্তীয় (Physiology) জটিলতা বোঝার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, একজন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক হিসেবে আমি এর সামাজিক ও নীতিগত দিকগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। বিশেষত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি সংক্রান্ত কর্মসূচির ঘোষণা ও নীতিনির্ধারণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি—পাবলিক হেলথ কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিষয় নয়; এটি মানবসম্পদ, খাদ্যনীতি, সামাজিক কাঠামো ও নৈতিক দায়বদ্ধতার একটি সমন্বিত ক্ষেত্র। জনস্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণে সাংবাদিকের ভূমিকা এখানেই গুরুত্বপূর্ণ—যেখানে তথ্য, নীতি ও মানবিক বাস্তবতা একে অপরকে ছেদ করে একটি বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও এমডিজি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সিডর, আইলা ও বন্যার মতো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হন। গার্মেন্টস শ্রমিক সহানার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দারিদ্র্য, দুঃখ ও পারিবারিক চাপ নারীদের মানসিক কষ্ট প্রকাশে বাধা দেয়; ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অদৃশ্য থেকে যায়।

বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৮.৭% মানুষ মানসিক সমস্যার শিকার, যার মধ্যে নারীদের হার ১৯%—পুরুষদের তুলনায় বেশি। গর্ভধারণযোগ্য বয়সের (১৫-৪৯) নারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার হার ৬-৭% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং কর্মজীবী নারীদের মধ্যে প্রায় ২৭.৮% নারী “গুরুতর থেকে অত্যন্ত গুরুতর” বিষণ্নতায় ভোগেন এবং ৩৬.৭% নারী তীব্র উদ্বেগে আক্রান্ত।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১১.৬% নারী মানসিক অসুস্থতা সত্ত্বেও কোনো মেন্টাল হেলথ সেবা নিয়েছেন। প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় যেখানে ০.১৬ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সেখানে নারীদের জন্য মানসিক সেবার প্রবেশগম্যতা অত্যন্ত সীমিত।

নারীর পুষ্টি-সংক্রান্ত দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মেয়ে শিশুরা ও নারীরা পুষ্টিহীনতার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১১.৯% মানুষ অপুষ্টির শিকার, এবং প্রায় অর্ধেক নারী পর্যাপ্ত খাদ্য বৈচিত্র্যের সুযোগ পাচ্ছেন না। নিম্ন আয়ের পরিবারে খাদ্য-অ্যাক্সেস, আয়-অনিশ্চয়তা ও পরিবেশগত চাপ নারীদের মানসিক চাপের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে।

খাদ্যসুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। খাদ্য-সংকট, ঘুমের অভাব ও ক্লান্তি মিলে উদ্বেগ, হতাশা ও মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিক নারীরা দিনে-রাতে কাজ, পরিবার ও আর্থিক দায়ে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে তাদের মানসিক রোগপ্রবণতা বেড়ে যায়।

কর্মক্ষেত্র, পরিবেশ ও পারিবারিক সম্পর্ক নারীর মানসিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দাম্পত্য জীবনে সহানুভূতি, পারিবারিক সমর্থন ও নিরাপত্তার অভাব একজন নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। আয়-অনিশ্চয়তা বা একমাত্র উপার্জনকারী হওয়ার দায়বদ্ধতাও নারীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়।

খাদ্যসুরক্ষা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও ভিত্তি। “আমি খাবার দেব কিনা”, “বাচ্চার জন্য যথেষ্ট খাবার আছে কি না”—এই চিন্তাগুলোই পরিণত হয় উদ্বেগ ও ক্লান্তিতে। খাদ্যসুরক্ষা কমে গেলে নারীর দায়বদ্ধতা বাড়ে, এবং তা তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে।

এখানে খাদ্যসুরক্ষা ও আয়-সুরক্ষা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দারিদ্র্য বা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে খাদ্য বৈচিত্র্যের অভাব নারীদের পুষ্টিহীন করে তোলে; এসেন্সিয়াল আয়রন বা ভিটামিনের অভাব মানসিক স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম-শহর বৈষম্য, সামাজিক মনোভাব ও দুর্যোগ-প্রবণতা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলছে। গ্রামীণ বা দরিদ্র এলাকায় পুষ্টিহীনতা ও মানসিক অসুস্থতা একত্রে দেখা যায়। একমাত্র উপার্জনকারী নারী, সময় ও সামাজিক সমর্থনের অভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন নারীর খাদ্যসুরক্ষা সংকুচিত করে, যা মানসিক চাপ ও হতাশা আরও বাড়ায়।

নারীরা মানসিক সেবা গ্রহণে পিছিয়ে—মূলত সামাজিক লজ্জা, অজ্ঞতা, তথ্যের অভাব ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। “মানসিক রোগ মানে পাগল”–এই ভুল ধারণা এখনও নারীকে সেবা থেকে দূরে রাখে।

এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক হিসেবে এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য ও ফুড সিকিউরিটি নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে পাঠকসমাজের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত সুপারিশ করা যায়—

প্রথমতঃ পুষ্টি-সম্পর্কিত কার্যক্রমের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যকে একীভূত করা জরুরি। নারী পুষ্টি উন্নয়নের প্রকল্পগুলোর মধ্যে কাউন্সেলিং ও মানসিক চেক-ইন যুক্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিক নারী বা খাদ্য-সংকটে থাকা নারীদের জন্য “Nutrition + Mental Wellness” ক্যাম্পেইন চালু করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ খাদ্যসুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী যেন পর্যাপ্ত খাদ্য ও আয়ের নিশ্চয়তা পায়, সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে আরও কার্যকর করা উচিত।

তৃতীয়তঃ মানসিক সেবায় প্রবেশগম্যতা ও সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন অপরিহার্য। মিডিয়া ও সাংবাদিকদের উচিত এই বিষয়গুলো বাস্তব জীবনের কাহিনি ও তথ্যে উপস্থাপন করে জনসচেতনতা বাড়ানো।

চতুর্থতঃ কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক সম্পর্ককে সহায়ক করা—বিশ্রাম, নিরাপত্তা, পারিবারিক সহযোগিতা ও মানসিক সহায়তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
পঞ্চমতঃ দুর্যোগ-পরবর্তী নারীদের বিশেষ সেবা প্রদান। ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় নারীর খাদ্য ও মানসিক সেবা একীভূত করা জরুরি।

বাংলাদেশে নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সমস্যা শুধুই ব্যক্তিগত নয়—এটি কাঠামোগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জটিল এক বাস্তবতা। “মনের সমস্যা” বা “শরীরের সমস্যা” হিসেবে একে আলাদা করে দেখা ঠিক নয়; বরং আর্থিক নিরাপত্তা, খাদ্যসুরক্ষা, কাজের পরিবেশ, পারিবারিক সহায়তা ও পরিবেশ-ঝুঁকি একত্রে বিবেচনা করতে হবে।
সাংবাদিক ও গবেষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এই জটিল বাস্তবতাকে তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ ও মানবিক কাহিনির মাধ্যমে সমাজের সামনে তুলে ধরা। যখন নারীর খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য-অ্যাক্সেস নিশ্চিত হবে, এবং তার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার ও সেবা প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি পাবে—তখনই আমরা সত্যিকার অর্থে বলতে পারব, বাংলাদেশে নারীর “সুস্থতা” একটি বাস্তব ও মানবিক সাফল্য হয়ে উঠেছে।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্রাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।

১১৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন