সাতক্ষীরায় “বৃত্তি উৎসব” এর আড়ালে শিক্ষা-বাণিজ্য রমরমা
শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সাতক্ষীরা শহরে বৃত্তি উৎসবের নামে শিক্ষা-বাণিজ্যের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়েছে। শহরের নামিদামি কোচিং সেন্টারগুলো “বৃত্তি পরীক্ষা”র আড়ালে চালাচ্ছে লাখ টাকার অর্থ উপার্জনের উৎসব।
শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, বরং অভিভাবকদের প্রতিযোগিতার মানসিকতাকে পুঁজি করে ফুলে-ফেঁপে উঠছে এই অবৈধ ব্যবসা।
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকালে সাতক্ষীরা শহরের নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে “বেসিক কোচিং সেন্টার” আয়োজিত “বেসিক বৃত্তি উৎসব-২০২৫” পরীক্ষায় দেখা যায় চরম বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা। সকাল থেকেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে হাজারো কোমলমতি শিক্ষার্থী ও উদ্বিগ্ন অভিভাবকে। বিদ্যালয়ের ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি, প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে বসানো হয়। পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল বা পানির ব্যবস্থা না থাকায় গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক শিশু।
একজন অভিভাবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার মেয়েকে প্রায় আধাঘণ্টা খুঁজে পাইনি। ভিড়ের মধ্যে কান্না শুনে শেষে খুঁজে পেলাম। এই অব্যবস্থাপনা যদি স্কুলেই হয়, তাহলে আমাদের সন্তানরা কোথায় নিরাপদ?”
অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়— যার মোট অঙ্ক প্রায় তিন লাখ টাকা। অথচ সেই অর্থের কোনো জবাবদিহিতা নেই। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই আয়োজিত এই বৃত্তি পরীক্ষা এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে।
অভিভাবক গোলাম সাকলাইন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এটা শিক্ষা নয়, সরাসরি বাণিজ্য। কোনো নিরাপত্তা বা তদারকি ছাড়া শত শত শিশুকে একত্রে বসানো হয়েছে। শুধুই টাকার লেনদেন।”
আরেক অভিভাবক নাদিম সাকের মনে করেন, “আমরাই সন্তানদের এই বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। সমাজে ‘ভালো রেজাল্ট’ দেখানোর প্রতিযোগিতা এখন শিশুদের মানসিক বিকাশকে ধ্বংস করছে।”
জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও এক অভিভাবক অ্যাড. কামরুজ্জামান ভুট্টো বলেন, “তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে অব্যবস্থাপনার মধ্যে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রায় তিন লাখ টাকা ফি সংগ্রহের বিপরীতে খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা। বাকিটা সরাসরি বাণিজ্য।”
শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, বৃত্তির নামে এমন প্রতিযোগিতা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর। মুখস্থবিদ্যা নির্ভর এই পরীক্ষাগুলো শিশুদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ ও আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি করছে। তারা বলেন, “যদি এখনই এই শিক্ষা-বাণিজ্যের লাগাম টানা না যায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃজনশীলতার বদলে মানসিক অবসাদে ভুগবে।”
নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক জানান, তার বিদ্যালয়ের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৫০০ শিক্ষার্থী। তবে আয়োজকেরা সেই সীমা অতিক্রম করেছে কিনা, তা তিনি নিশ্চিত নন। বিদ্যালয় ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ খরচ বাবদ মাত্র দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।”
অন্যদিকে বেসিক কোচিং সেন্টারের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা নিয়ম মেনে বিদ্যালয় ভাড়া নিয়েছি এবং শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছি।”
এদিকে, সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আগেই শিক্ষা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” ঘোষণা করলেও শহরের একাধিক কোচিং সেন্টার সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে বৃত্তির নামে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জনে মেতে উঠেছে।
সচেতন মহলের দাবি, অবিলম্বে প্রশাসনকে এসব বাণিজ্যিক বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা আয়োজন নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের ভাষায়, “শিক্ষা যেন ব্যবসা নয়— মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও নিরাপত্তার জায়গায় ফিরে আসে। শিশুদের কান্না আর যেন কোনো পরীক্ষার প্রাঙ্গণ না ভরিয়ে তোলে।”
১১১ বার পড়া হয়েছে