সর্বশেষ

ফিচার

মানববাদী কবি মধুসূদন

গাউসুর রহমান
গাউসুর রহমান

শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
মধুসূদন নিঃসন্দেহে মানবতাবাদী, মানববাদী কবি। মানবতাবাদী কবি হিসেবে অনেক দিনের মূল্যবোধ থেকে সরে এসেছেন।

পুরাতন মূল্যবোধ ভেঙ্গে আস্থা স্থাপন করেছেন নতুন মূল্যবোধে। ভারতীয় সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ হচ্ছে: রাবণ রাক্ষস হিসেবে ঘৃণার পাত্র এবং রাম দেবতা হিসেবে নমস্য, পূজনীয়। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য রাবণ-মেঘনাদকে উজ্জ্বল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, রাবণ-মেঘনাদের মধ্যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ও মানবিক গুণাবলী সঞ্চারিত করেছেন। অন্যদিকে রাম ও লক্ষণকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে ভাষা দিয়েছেন। ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্যে রাম ও লক্ষণ তুচ্ছ, হেয় ও ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

 

মাইকেল মুধুসূদন দত্ত বাংলায় এক নতুন ছন্দ প্রবর্তন করেন। এ ছন্দের নাম অমিত্রাক্ষর ছন্দ। মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনা করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে। মাইকেল এ ছন্দ প্রবর্তন করেন মিল্টনের Blank Verse -এর অনুসরণে, কিছুটা আদলে।

 

মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে হোমারকে অনুসরণ করেছেন মধুসূদন। তিনি দীর্ঘ উপমা প্রয়োগ করেছেন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে। মানুষের শৌর্য-বীর্য রূপায়ন করতে গিয়ে তিনি হোমারের মতোই ব্যাঘ্র, সিংহ ইত্যকার হিংস্র এবং অগ্নি, বায়ু, সমুদ্র ইত্যাকার প্রকৃতির প্রলয়ঙ্করী শক্তির উপমা বিরতিহীনভাবে চয়ন করেছেন।

 

এ প্রসঙ্গে টি.এস. এলিয়টের মন্তব্য মনে করতে পারি। এলিয়টের মতে, হোমারই ইউরোপীয় ঐতিহ্যের নির্মাতা। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে হোমার এই ইউরোপীয় ঐতিহ্যের নির্মাণ করেছেন। এরপর ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক সেই ঐতিহ্যকে আত্তীকরণ করেছেন। যেমনটি মধুসূদনও করেছেন। মধুসূদন এই ঐতিহ্যের ধারায় বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতাকে আনয়ন করেছেন। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে সেই সাক্ষ্যই বহন করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাঙালি প্রথম ইউরোপীয় ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছে ঊনিশ শতকের নবজাগরণের ফলে। মধুসূদন সেই ঐতিহ্যকে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য সহ তাঁর অন্যান্য সাহিত্য রচনায় ধারণ করেছেন। হোমারই বিশ্ব সাহিত্যে প্রথম মানবতার আরাধনাকে ঠাঁই দিয়েছেন। মধুসূদনও মানবতার মন্ত্রে সঞ্জীবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছেন। হোমার পাপ-পূণ্যের প্রশ্নে বিড়ম্বিত কিংবা বিচলিত হননি। প্রচলিত মূল্যবোধ কিংবা ন্যায়বোধ দ্বারাও পরিচালিত হননি। তিনি মানুষকে নিজের শৌর্যে-বীর্যে বলীয়ান করে দেখেছেন। সর্বোপরি মানুষকে মহিমান্বিত করেছেন। মানুষকে বিরাটত্ব ও বড়ত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত-ও রাবণকে প্রচলিত পাপ-পূণ্য দ্বারা পরিচালিত করেননি। প্রচলিত মূল্যবোধে রাবণের পাপকে তিনি পাপ হিসেবে দেখেননি। মনুষত্বের, মানবিকতার মহিমায় রাবণকে তিনি মহৎ করে তুলেছেন, বড় করে তুলেছেন। হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যে যেমন একিলিস ও হেক্টর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের রাবণ ও মেঘনাদ নিজ নিজ শৌর্য ও বীর্য নিয়ে মানব জীবনের মহিমা কীর্তন করেছেন।

 

ইলিয়াড’ এবং ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে জীবনের ট্র্যাজিক রূপ ভাষা পেয়েছে। ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যে পাঠক লক্ষ্য করেন ধ্বংসের বিপুল আয়োজন এবং এ কাব্য শেষ হয়েছে শবদাহে। তেমনি ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের শেষ হয়েছে মেঘনাদের শেষকৃত্যের মধ্য দিয়ে। আলোচ্য দু’টি কাব্যেই ধ্বংস ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জীবনের অমর মহিমার কীর্তন করা হয়েছে।

 

পাঠককুল ‘ইলিয়াড’ কাব্যে লক্ষ্য করবেন যে, এ কাব্যে মানববাদ, মানবতাবাদ ও জীবন ধর্ম আপন মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মানুষের জীবনধর্মকেই হোমার ধর্মরূপে জেনেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন। তিনি মানবজীবনের শৌর্য, বীর্য, শক্তি, বলকে চরম ও পরম মূল্য দিতে অকৃপণ ছিলেন। ‘ইলিয়াড’ কাব্যে একদিকে একিলিস; অন্যদিকে হেক্টর ও ওডিসিস। এ কাব্যে বীর একিলিস এক পর্যায়ে সংকটের মুখোমুখি হন। দেবী-পুত্র একিলিসের অজানা নয় যে, ট্রয় থেকে যুদ্ধ করলে তাকে অনিবার্যভাবেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। সে জানে যে, যুদ্ধ না করে দেশে ফিরে গেলে সে দীর্ঘজীবী হবে। কিন্তু গৌরবহীন দীর্ঘ জীবন তার কাম্য নয়। সে মনে করে যে, গৌরবহীন দীর্ঘ জীবনের চেয়ে গৌরবময় স্বল্পায়ু জীবন বীরের জন্য কাঙ্ক্ষিত। এই স্বল্পায়ুজীবন বীরের শ্রেয় ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ। বীর একিলিস হাসিমুখে নিজের ইচ্ছায় স্বল্পায়ু জীবনকে বেছে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে রইলেন। হেক্টরের জবানীতে একিলিসের বীরধর্ম ভাষা পেয়েছে এভাবেঃ “Life may be short, yet one must face it affirmatively without fear or complaining, love nobly and make one’s life glorious, so that further generation will remember it.”

 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত একই সঙ্গে যুগন্ধর এবং যুগোত্তীর্ণ কবি। তিনিই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার রাজপথ নির্মাণ করেছেন। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার যুগপৎ সাক্ষাৎ মেলে। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাব ছিলো অমিত সম্ভাবনার বর্ণিল স্মারক। এই মহাকাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রভাব- একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়। তবে পাশ্চাত্য এভাবেই মাইকেল মহাকবি, কবি, নাট্যকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার গোড়াপত্তন করেছেন। আধুনিক কবি, মহাকবি, নাট্যকার হিসেবে নিজেকে অগ্রপথিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

 

মধুসূদন মানবতন্ত্রী। তিনি তাঁর কাব্যে মনুষ্যত্বের পরিচর্যা করেছেন। হিন্দু ঐতিহ্যের মিথ্যে আয়োজনের বিপক্ষে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আত্মবিশ্বাসে ঋদ্ধ মধুসূদন আত্মশক্তিতে আস্থা স্থাপন করেছেন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। মধুসূদনের ক্ষেত্রে তাই আত্মবিস্মরণ লক্ষ্য করা যায় না। তিনি মনুষ্যত্বের পরিচর্যা করেছেন, মানবমুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। তিনি তাঁর ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে দেখিয়েছেন যে, শক্তি ও মুক্তি একে অপরের পরিপূরক। মানুষকে তিনি কখনো ক্ষুদ্র কিংবা তুচ্ছ ভাবেননি। মানুষের মধ্যে তিনি অমিত সম্ভাবনা দেখেছেন। মানুষের মধ্যে তিনি বিচিত্র সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন, তা তাঁর ইতিবাচক কবিমানসেরই দ্যোতক। অন্ধ প্রথার দাসত্ব তিনি মেনে নেননি। নিয়ম-নিগরের মধ্যে তিনি নিজেকে বন্দি করে রাখেননি। যে শাস্ত্র মানুষকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বিবেচনা করে, মধুসূদন সেই শাস্ত্রের বিপক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। মানবজীবনের মহিমাই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে ফুটে উঠেছে। আত্মশক্তি মেঘনাদবধ কাব্যের নিয়ামক শক্তি।

 

বাঙালির নিত্যদিনের যাপিত জীবনে মধ্যে মধুসূদন সংকীর্ণতা ও পরশ্রীকাতরতা প্রত্যক্ষ করেছেন; প্রত্যক্ষ করেছেন জড়তা, দীনতা, গ্লানি, ক্লেদ। এ-সবের মধ্যে তিনি পেয়েছেন নতুন জীবন ও জগতের সন্ধান। মধুসূদন নিজের মধ্যে অপরিমেয় শক্তি আবিষ্কার করেছেন। ইউরোপীয় সভ্যতার বাহ্যিক রূপ মধুসূদনকে খুব একটা টানেনি, বরং তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার অন্তর্নিহিত স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন।

 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঊনিশ শতকের নবজাগরণের কবি। তিনি জীবনের মধ্যে উল্লাস আবিষ্কার করেছেন, জীবনের ব্যাপ্তিকে সীমাহীন বলে বিবেচনা করেছেন। পাশাপাশি জীবনের মধ্যে মুক্তির স্বাদ অনুভব করে তৃপ্ত হয়েছেন তিনি। তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। মধুসূদনের কবিমানস জিজ্ঞাসা-কাতর। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথপ্রদর্শক মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে যেমন নবজাগরণে দীক্ষিত করেছেন, তেমনি ঊনিশ শতকের বাঙালি জীবনকে রেনেসাঁসের সন্ধান দিয়েছেন। মধুসূদনের হাতেই বাংলা সাহিত্য নতুন বাঁক-কোণ-মোড় ঘুরেছে। বাংলা সাহিত্যে এসেছে নতুন প্রকরণ, প্রসঙ্গ, ভাষা ও ছন্দে ঘটেছে আধুনিকতার সূত্রপাত।
মধুসূদন মানবতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন। কাব্যে তিনি মানুষেরই প্রশাস্তি করেছেন। দেবতার প্রশাস্তি করেননি। হোমারও তাঁর কাব্যে মানুষের প্রশাস্তি করেছেন, মানুষের মহিমার ব্যাখ্যা বলেছেন তাঁর ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’ কাব্যে। এই দুই কাব্যে তিনি দেবতার প্রশাস্তি করেননি। মধুসূদন মানবজীবনের শক্তিকে পরম ও চরম মূল্য দিয়েছেন তাঁর ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে। তাঁর ‘ইলিয়াড’ কাব্যে একদিকে একিলিস, অন্য পক্ষে হেক্টর এবং ওডিসিস। ইলিয়াড কাব্যে লক্ষ্য করা যায়- বীর একিলিস এক মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি। দেবী-পুত্র একিলিসের ভালোভাবে জানা যে, ট্রয়ে থেকে যুদ্ধ করলে তাকে অনিবার্যভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। একিলিস যদি যুদ্ধ না করে দেশে ফেরৎ যায়; তাহলে সে দীর্ঘজীবন লাভ করবে। একিলিস মনে করে- গৌরবহীন দীর্ঘ জীবনের গৌরবময় স্বল্পজীবনই শ্রেয়। বীর একিলিস তাই মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। হোমারের বীরধর্ম সম্বন্ধে হেক্টরের জবানীতে পাঠক জানতে পারেন “Life may be short, yet one must face it affirmatively without fear or complaining, love nobly and make one’s life glorious, so that further generation will remember it.”

 

আর একারণেই সার্পিডন ট্রয়ের যুদ্ধকে “man ennobling battle” হিসেবে অভিহিত করেছেন। মুধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রাবণ সুস্থ দেহাত্মবাদী মানুষ। সে মানবধর্মে দীক্ষিত। তার জীবনের ধারা সহজ, সরল। সীতাকে সে অপহরণ করেছে বোন শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধ নিতে। অথচ সে নিয়তি- লাঞ্চিত। এরপরও বিরুদ্ধশক্তির কাছে সে মাথানত করেনি। বরং আপনার ভাগ্যকে ভ্রকুটি হেনেছে। রাবণপুত্র মেঘনাদের মধ্যে রাবণের শক্তি ও পৌরুষ প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। মেঘনাদ সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে একাই মোকাবিলা করেছে। শেষতক বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। তাই তার মৃত্যু মহিমান্বিত।

 

হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যের সাথে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের অভূতপূর্ব মিল লক্ষ্য করা যায়। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লঙ্কাপুরীর পটভূমিতে রচিত। ‘ইলিয়াড’ কাব্যের পটভূমি ট্রয় নগরী। লঙ্কাপুরী সমুদ্রবেষ্টিত এক দ্বীপ। আর ট্রয় নগরী সমুদ্রের তীরে অবস্থিত। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের শুরুতে সমুদ্র, শেষে সমুদ্র। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের কাহিনীর উৎস এবং ‘ইলিয়াড’ কাব্যের কাহিনীর উৎসের মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হোমার এবং মধুসূদন দু’জনেই পুরাণ থেকে কাহিনী চয়ন করেছেন। হোমার গ্রীক পুরাণ থেকে এবং মধুসূদন ভারতীয় পুরাণ থেকে কাহিনী চয়ন করেছেন।

 

ইলিয়াড’ কাব্যের মতোই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের মূলে রয়েছে পরস্ত্রী অপহরণজনিত। রাক্ষসরাজ রাবণ রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করেছেন। মেঘনাদের মৃত্যুতে দেবতাদের চক্রান্ত কাজ করেছে, বিভীষণের সহায়তা কাজ করেছে, কাজ করেছে লক্ষণের কঠিন ও কঠোর প্রস্তুতি। শেষতক মহাবীর মেঘনাদের মৃত্যুতে বিস্ময়বিমূঢ় জিজ্ঞাসায় মানবাত্মা আর্তনাদ করে ওঠে।

 

মধুসূদন মানবতার মন্ত্রে সঞ্জীবিত, উজ্জীবিত ও পরিপুষ্ট। তিনি ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যকে কাব্যে ধারণ করেননি। রাবণ মানবভাগ্যের প্রতীক। তার মানবীয় শক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সেই শক্তি প্রকাশের দুরন্ত আবেগে বিশ্ববিধান লঙ্ঘন করতে সাহসী, উদ্যমী। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে রাবণ ও মেঘনাদ চরিদ্রে মানব জীবনের শক্তির মহিমাই ঘোষিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতা তাঁকে মানবজীবনে ও মানব-ভাগ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসু করে তোলে। এরই প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে। এটিতো সত্য কথা যে, মধুসূদন ব্যক্তি জীবনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ ব্যর্থতাই তাঁকে কৌতুহলী করে তুলেছিলো মানবজীবনের ট্রাজেডী সম্পর্কে। গ্রীক ট্রাজেডীর মানব-জীবনের বিষাদ-করুণ দিকটি মধুসূদনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। ‘মেঘনাদবধ’মহাকাব্যে মানবাত্মার নিদারুণ বেদনা এবং দুঃসহ, কঠিন, কঠোর পীড়ণের চিত্র ওঠে এসেছে রক্ত-মাংস-অস্থিমজ্জাসহ রক্তাক্ত নগ্নতায়। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্যে আমরা জীবনের মুক্তি ও ব্যাপ্তি লক্ষ্য করি। এটি ঊনিশ শতকের ইউরোপী রেনেসাঁস বা নবজাগৃতির প্রত্যক্ষ ফল। রাবণ ঊনিশ শতকের নবজাগ্রত জীবন-চেতনার প্রতীক। এই রাবণ পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার ব্যক্তিত্ব বহুমুখী এবং বৈচিত্র্যমন্ডিত। এই রাবণ শত পুত্রের পিতা, স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বর, চিত্রাঙ্গদা ও মন্দোদরীয় এর স্বামী, সাহসী, অকুতোভয়, মস্তবড় যোদ্ধা এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ সেনাপতি। রাবণ মহাবিদ্রোহী, তার ঔদ্বত্য আকাশস্পর্শী। বিশ্ববিধানকে সে ভ্রকুটি হানতে অভ্যস্ত। সে ধ্বংস হয়ে যাবে; তবু হার স্বীকার করবে না। এই বিদ্রোহী আত্মা তাই অপরাজেয় গৌরবের অধিকারী। এই মুক্ত আত্মার কাহিনী মানবজীবনের মহিমাকেই মহিমান্বিত করে। রাবণ অমরত্ব প্রত্যাশী। নিজের পুত্র মেঘনাদের মাধ্যমে সে অমর হতে চেয়েছে।

 

সমুদ্রতীরে শ্মশানে মৃতপুত্রকে উদ্দেশ্য করে রাবণ বলেছে-

“ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে—
সপি রাজ্যভার পুত্র, তোমায়, করিব
মহাযাত্রা।”

প্রতিটি মানুষ যেমন আশা করে, রাবণও সেরূপ আশা করেছিলো। মধুসূদন মানবজীবনের মহনীয়তা রূপ দিয়েছেন ‘মেঘনাদবধ’মহাকাব্যে। ব্যক্তিসত্তা উপলব্ধিকে তিনি এ কাব্যে প্রতিফলিত করেছেন। ব্যক্তির চিত্তজাগরণকে তিনি কাব্যে ধারণ করেছেন।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

১৮১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
ফিচার নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন