সর্বশেষ

মতামত

যৌনপল্লীর শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকার

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:৫৪ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এমন কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের অস্তিত্ব যেন রাষ্ট্র ও সমাজের চোখে অদৃশ্য। যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা শিশুদের জীবন তাদেরই অন্যতম করুণ অধ্যায়।

এই শিশুদেরকে জন্ম থেকেই সমাজের মূলধারার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়—যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা, এমনকি পরিচয় পর্যন্ত তাদের জন্য বিলাসিতা। অথচ এরা কারও অপরাধে অপরাধী নয়, বরং অন্যায়ের শিকার এক অনাগত প্রজন্ম।

যৌনপল্লীর শিশুরা: অন্ধকারের ভেতর বেড়ে ওঠা এক প্রজন্ম-বাংলাদেশে প্রায় ২৫টি বড় যৌনপল্লী রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও পরিচিত হচ্ছে টানবাজার, কান্দাপাড়া, দৌলতদিয়া, ও মাদারীপুরের যৌনপল্লীসমূহ। গবেষণায় দেখা যায়—এই যৌনপল্লীগুলোতে বসবাসকারী যৌনকর্মীদের প্রায় ৬০ শতাংশেরই সন্তান রয়েছে, যাদের ৮০ শতাংশ কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি নয়। কারণ, স্থানীয় বিদ্যালয়গুলো অনেক সময় তাদের সন্তানদের ভর্তি নিতে অনীহা প্রকাশ করে, এমনকি অন্য অভিভাবকেরা প্রতিবাদ করেন।

এই শিশুরা প্রায়শই “অবৈধ” বা “পল্লীর সন্তান” পরিচয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যৌনপল্লীর সংকীর্ণ গলির মধ্যেই তাদের খেলার মাঠ, শিক্ষার জায়গা ও জীবনের সীমা নির্ধারিত হয়ে যায়। অল্প বয়সে তাদের অনেককেই বাধ্য করা হয় মায়ের পেশা উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করতে। এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলতে থাকা এক “অন্ধকার চক্র”—যা শিক্ষা দিয়েই ভাঙা সম্ভব।

শিক্ষা তাদের মৌলিক মানবাধিকার-বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করিবে।” একইভাবে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ২৮ ধারায় শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যৌনপল্লীর শিশুদের জন্য এই সাংবিধানিক অধিকার প্রায় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তারা রাষ্ট্রের শিক্ষা কাঠামোর বাইরে, অথচ তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষা ও নৈতিক পুনর্গঠন।

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) এবং বর্তমান টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)-এর মূল প্রতিশ্রুতি হলো “Education for All” বা “সবার জন্য শিক্ষা”। কিন্তু দুঃখজনক হলো—যৌনপল্লীর শিশুরা এখনো সেই ‘সবার’ অংশ হতে পারেনি। এদের অনেকেই জন্ম সনদ পর্যন্ত পায় না, ফলে বিদ্যালয়ে ভর্তি, চিকিৎসা সেবা কিংবা সরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত থাকে।

শিক্ষা থেকে বঞ্চনা মানে ভবিষ্যৎ থেকে বঞ্চনা

দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক জরিপে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ শিশুই কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি, আর যারা গিয়েছিল তাদের ৯০ শতাংশই প্রাথমিক স্তর শেষ করতে পারেনি। শিক্ষা না থাকার ফলেই এই শিশুরা জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই সীমিত বিকল্প দেখতে পায়—যেখানে অল্প কিছু ছেলেশিশু শ্রমজীবী হয়ে যায়, আর মেয়েরা অল্প বয়সেই মায়ের পেশায় জড়িয়ে পড়ে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে যৌনপল্লীর সন্তানদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ বিকল্প পেশায় যেতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ শিক্ষা শুধু তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে না, বরং প্রজন্মান্তরে পেশাগত শৃঙ্খল ভাঙার একমাত্র কার্যকর উপায়।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন-যৌনকর্মীদের সাম্প্রতিক এক সেমিনারে তাঁরা নিজেরাই দাবি তুলেছেন—তাঁদের সন্তানদের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করার। কারণ তারা বুঝেছেন, ধর্ম ও নৈতিকতা শিশুদের আত্মমর্যাদা,মানবিকতা ও আত্মচেতনা ফিরিয়ে আনে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেও শিক্ষা সকল মানুষের জন্য ফরজ (বাধ্যতামূলক)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ, হাদীস: ২২৪)।

সুতরাং যৌনকর্মীদের সন্তানরা যেমন মানবিকভাবে সমান, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিতেও সমান শিক্ষার অধিকার রাখে। তাদের জন্য মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।

পুনর্বাসন ও কারিগরি প্রশিক্ষণ: একটি মানবিক কর্মপরিকল্পনা-শিক্ষার পাশাপাশি তাদের জন্য দরকার কর্মসংস্থানমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা। কারিগরি প্রশিক্ষণ, সেলাই, বিউটিপার্লার, ইলেকট্রিক মেরামত, কৃষি বা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা—এসব উদ্যোগ তাদের আত্মনির্ভরশীল করতে পারে।

সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, এনজিও ব্যুরো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগে ইতিমধ্যে কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে—যেমন “আমাদের সন্তান” প্রকল্প (BRAC), “সারথি” প্রোগ্রাম (Ain o Salish Kendra), এবং “প্রান্তিক শিশু শিক্ষা প্রকল্প” (UNICEF Bangladesh)। তবে এই প্রকল্পগুলো এখনো অল্প কিছু যৌনপল্লী পর্যন্ত সীমিত। জাতীয় পর্যায়ে বৃহৎ আকারে এগুলো সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

মানবাধিকার ও সামাজিক দায়বদ্ধতা-বাংলাদেশের সংবিধান শুধু রাষ্ট্রকেই নয়, সমাজকেও সামাজিক দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানায়। যৌনপল্লীর শিশুদের প্রতি বৈষম্য ও সামাজিক ঘৃণা দূর না করলে রাষ্ট্রীয় আইন কার্যকর হলেও প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না। সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনের মানবিক ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।

যেমন, কান্দাপাড়ার যৌনপল্লীতে ২০২১ সালে স্থানীয় শিক্ষকদের উদ্যোগে “আলো বিদ্যালয়” নামে একটি ছোট স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যেখানে ৮০ জন শিশু মূলধারার পাঠক্রমে পড়ছে। এই উদ্যোগ দেখিয়েছে—যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে অন্ধকারের গলিতেও আলো জ্বালানো যায়।

ধর্মীয় শিক্ষা হোক মুক্তির পথ-

একটি সমাজ তখনই সভ্য বলা যায়, যখন সে তার প্রান্তিকতম নাগরিকের অধিকার রক্ষা করে ধর্মীয় ও মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে । যৌনপল্লীর শিশুদের বঞ্চিত রাখা মানে আমাদের ভবিষ্যৎকেই বঞ্চিত করা। শিক্ষা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানগত সুযোগ নয়—এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি, মানবমর্যাদার প্রতীক এবং দারিদ্র্য-অমানবিকতার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ।

আজ সময় এসেছে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্মীয় সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রে কাজ করার—যাতে যৌনপল্লীর এই শিশুরা “পল্লীর সন্তান” নয়, “জাতির সন্তান” হয়ে উঠতে পারে।
কারণ তারাও মানুষ। তারাও নাগরিক। তারাও সেই সূর্যের আলোয় জন্মেছে, যেখানে শিক্ষা ছাড়া কোনো শিশু যেন আর কখনো অন্ধকারে না হারায়।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্রাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।

১১৯ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন