কুয়াকাটার বনাঞ্চল ধ্বংসের পথে, হুমকিতে উপকূলের লাখো মানুষ

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫ ২:৪৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
কুয়াকাটার লেম্বুরবন, গঙ্গামতি, চর গঙ্গামতি, ইকোপার্ক, নারিকেল বাগান ও ঝাউবন—নামেই এখন পরিচিত এই বনাঞ্চল।
বাস্তবে এসব বনভূমি আজ ধ্বংসের মুখে। একদিকে সমুদ্রের ভাঙন, অন্যদিকে গাছ কেটে বন উজাড়—দুইয়ের চাপে বিপন্ন হয়ে পড়েছে উপকূলীয় পরিবেশ এবং ঝুঁকিতে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রভাবশালীদের লাগামহীন গাছকাটা ও বন বিভাগের নীরবতা বন ধ্বংসের মূল কারণ। অভিযোগ রয়েছে, বনকর্মীদের মদদেই দিনে-দুপুরে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। বন বিভাগ অবশ্য বলছে, লোকবল সংকট ও নিরাপত্তার অভাবের কারণে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
সম্প্রতি গঙ্গামতি ও চর-গঙ্গামতি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শত শত ঝাউগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছের গোড়া ফেলে রেখে কাণ্ড ও ডালপালা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় এক জেলে বলেন,
“আমরা গাছ কাটি না, ডালপালা কেটে জালের খুঁটা বানাই। ফরেস্টার জাকির স্যার ডাল কাটতে বলেছেন, গাছ কাটতে বলেননি।”
তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, কেবল ডালপালা নয়, মূল গাছও কেটে নেওয়া হয়েছে।
৪ সেপ্টেম্বর গঙ্গামতির লেকের পাড় থেকে প্রায় ৫০টি ঝাউগাছ কেটে জালে খুঁটি তৈরির জন্য ট্রলারে তুলে নিতে দেখা যায় ৯ জন জেলেকে। স্থানীয়রা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে অবৈধ বেহুন্দী জাল বসাতে এসব গাছ কেটে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে জেলেরা।
এক সময় যেখানে আকাশমণি, রেইনট্রি, কেওড়া, সুন্দরীসহ নানা প্রজাতির গাছ দেখা যেত, সেখানে এখন শুধুই ঝাউগাছের ভগ্নাবশেষ। বন উজাড় হওয়ায় ভাঙন ঠেকাতে পারছে না উপকূল।
হোসেন পাড়ার বাসিন্দা মো. আ. মোতালেব (৫৫) বলেন, “এই বনই ছিল উপকূলের ঢাল। সিডর, আইলা, নার্গিসের মতো ঘূর্ণিঝড়েও আমাদের রক্ষা করেছে। এখন বন নেই বললেই চলে, ফলে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকছে। বড় দুর্যোগ এলে হয়তো আর বাঁচতে পারব না।” মাটিকাটা ও দুর্নীতির অভিযোগ সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দক্ষিণ মুসল্লীয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা মো. হযরত আলী বলেন, “মহিপুর রেঞ্জের সাবেক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বনের গাছ কাটার পাশাপাশি মাটিও বিক্রি করেছেন। কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি।”
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ দাবি করেন, “আমি ১৪টি মামলা করেছি, ১০টি মাটিকাটা ট্রাক জব্দ করেছি। চারজনকে জেলে পাঠিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা মিথ্যা।”
বর্তমান রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম মনিরুজ্জামান জানান, “আমি মাত্র ২ মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। দুর্বৃত্তরা আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাছ কাটছে। আমরা মামলা দিয়েছি, কিন্তু লোকবল ও নিরাপত্তার অভাবে অভিযান পরিচালনায় বাধা আসে।” তিনি আরও জানান, গাছ কাটার সময় বন কর্মীদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকিও পেতে হয়।
২০০৫ সালে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কুয়াকাটা ইকোপার্ক ২০১০ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা পায়। কিন্তু এখন সেটিও প্রায় নিশ্চিহ্ন। সমুদ্র ভাঙনের পাশাপাশি বন উজাড় করায় পার্কের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (উপরা) আহ্বায়ক কে এম বাচ্চু বলেন, “এই সংরক্ষিত বন শুধু গাছ নয়, উপকূলের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করত। বন ধ্বংস মানে মানুষের জীবন হুমকিতে পড়া। সরকারকে এখনই বনখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান মিঞার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া মেলেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
১১৪ বার পড়া হয়েছে