সর্বশেষ

মতামত

হৃদয় মোচড়ানো কিছু শৈশব স্মৃতিঃ দেশত্যাগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

কাজী আখতার হোসেন
কাজী আখতার হোসেন

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
আমার শৈশব কেটেছে প্রধানত হিন্দু বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে নানা আনন্দে। ষাটের দশকের প্রারম্ভে এ রকমই অবস্থা ছিল সম্ভবত প্রায় সব জায়গাতেই। সংখ্যার বিষয়টা প্রধানত বললে বোধ হয় ভুল হবে, অধিকাংশ বলা চলে।

কুমারখালী শহরে আমাদের বাড়ির চারপাশেই ছিল হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি ঘর। একটি তো কালি মন্দির ছিল প্রায় সংলগ্ন। শারদীয় উৎসবের শুরুতে রেডিওতে পাশের বাড়ি থেকে অতি প্রত্যুষে মহালয়া শুনতাম। না বুঝলেও মজা পেতাম খুব। যখনকার কথা বলছি তখন পর্যন্ত বালক-বালিকার পার্থক্য ভালো করে বুঝিনি । তাই আমরা হইচই করে একসঙ্গেই দিন কাটাতাম।পূজার সময় ওরা মেলায় যাবার জন্য সারাবছর টাকা জমিয়ে রাখত, মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরত আমরাও থাকতাম সাথে সাথে। মেলায় যেয়ে এটা সেটা কিনতাম, বাজী- পটকা ফুটাতাম।

যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, তখন আমাদের পাশের বাড়িতে শহরের তেবাড়িয়া থেকে একটি পরিবার এল থাকতে। ক্রমান্বয়ে সেই পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক হয়ে গেল আমাদের। সেই পরিবারে তিন ভাই দুই বোন। দুটো ভাই আমার বড়, অন্যরা আমার ছোট। একটু অন্যভাবে নামগুলো বলি, শান্ত নিরব প্রতীক স্মৃতি ও ইতি। প্রতীক হয়ে উঠলো আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, যদিও সে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। আমার মা সকাল-বিকাল ও বাড়িতে যান,ওই বাড়ির কাকিমা ও আমাদের বাড়িতে না এলে ভাত হজম হয়না। আমার ছোট বোন খেলাধুলা করে ওদের ছোটবোন ইতির সাথে। আরেক বোন স্মৃতি আমার এক ছোট ভাই কে কোলে নিয়ে দিন কাটায়।আমার সেই ছোট্ট ভাইটি ও তার কোল পেলে আর কিছু চায়না পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যায়।স্কুল ও পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে প্রতীক ও আমি তৈরি করি নিজস্ব ভুবন।সময়কে তখন দীর্ঘ বলে মনে হতো , এখনকার মতো ফুড়ুৎ করে সময় কেটে যেত না। ফুটবল ব্যাডমিন্টন মাঠের এইসব খেলাধুলা ছাড়াও তখনকার আমাদের ছোট্ট ভুবনে অনেক কিছুই করতাম আমরা। গড়াই নদীর তীর ছিল বেশ দূরে।প্রতীক আর আমি গলাগলি ধরে হেঁটে হেঁটে কতদিন যে নদীর তীরে খেয়া ঘাটে বসে সময় কাটিয়েছি তার হিসেব নেই। গল্পের বিষয় বস্তুর মধ্যে লেখাপড়া, ক্লাস পারফরম্যান্স, শিক্ষকদের আচরণ, কে বেতের মার খেলো সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকতো। প্রতীকের সঙ্গে একদিন দেখা না হলে দিনটা অর্থহীন হয়ে যেত। একদিন না বলে বরং একবেলা বললে বোধহয় সঠিক হত। একইভাবে আমাদের পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে ওদের পরিবারের চলছিল এক অভূতপূর্ব স্বপ্নের সম্পর্ক।

একদিন জানলাম, ওরা আসলে ভারতে চলে যাবে। শান্ত দা ও তাদের বাবা ওপারে চলে গেছেন সবকিছু ঠিকঠাক করতে। ওই বাংলায় সবকিছু ঠিকঠাক গোছগাছ হয়ে গেলে এরাও সবাই চলে যাবে। সবকিছু শুনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম। প্রতীক আর আমি অনেক আলাপ করলাম এই প্রসঙ্গে। দেখলাম ওরও মন খুব খারাপ। বলল দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে ওর একদম ইচ্ছা নেই। প্রতীকের বোন স্মৃতির সঙ্গে আলাপ করলাম অনেকক্ষণ ধরে। দেখলাম চোখ টলটলে, অশ্রু ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল, দেখো আমার ও তোমাদের কাউকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু বেশিরভাগ আত্মীয়-স্বজন তো ইন্ডিয়া চলে গেছে। সবাই পরামর্শ দেয় এ দেশে থেকে কোন লাভ নেই, যেতে যখন হবেই আগেভাগে যাওয়াই ভালো। মন সায় দেয় না কিন্তু কিছুই করার নেই।

জানলাম ওদের তেবাড়ীয়ার বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। তবে কবে ওরা সবাই একযোগে চলে যাবে সে সময় এখনো ঠিক করা হয়নি। প্রতীক আমার সহপাঠী নয়, তবুও সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গী সেই। পাশেই পুতুল বাড়িতে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলি, নানা গল্প করি। ওরা দেশ ত্যাগ করে চলে যাবে কিছুদিন যেন এটি ভুলে গেলাম আমরা।চলছে সবকিছু আগের মতোই। বিশেষ করে আমার কনিষ্ঠ ভাইটি স্মৃতিকে না দেখলেই কান্নাকাটি শুরু করত। সেও স্কুল থেকে ফিরেই ওকে কোলে তুলে নিত। আমার মা ওদের মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে বসে মনের সুখে পান খেত। কে হিন্দু-কে মুসলমান এটি আমাদের ভুলেও কখনো মনে আসেনি।

আমার পিতা শহরের প্রধান আলেম ছিলেন । বড় জামে মসজিদের ইমাম। তিনি ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ছিলেন। অতি ভোরবেলায় লক্ষ্য করতাম মানুষ তার কাছে পানি পড়া নিয়ে যেত ঝাড়ফুঁক করে নিত। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল যে এইসব মানুষদের বড় একটি অংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাও ছিল কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার। যেমন আকালে ঠাকুর ও ব্রজগোপাল ঠাকুরের পরিবার থেকে পানি পড়ে নিতে আসতো।

দিন ভালই চলছিল। অবশেষে এলো সেই দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত। শুনলাম প্রতীকরা কালই চলে যাবে। ওদের মা আমার মাকে কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে।কথাটা শুনে ভেতরে প্রচন্ড শক পেলাম। মনে হল হৃদয়ের তারগুলো বোধ হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে । কিছুই ভালো লাগছে না, কোথায় যে পালাই। কোথায় যে স্বস্তি কোথায় যে শান্তি! সে রাতটা ছিল যেন দীর্ঘতম রাত।ভোরবেলায় বিষন্ন মনে আমি একাই গড়াই তীরে যেয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম। সমস্ত প্রকৃতিতে বিদায় ও বিষন্নতার ছায়া দেখলাম।নদীর কুলু কুলু ধ্বনি তে আমি বেদনার অনুরণন শুনলাম।
এক সময়ে হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ি আসতে গেটের মুখে ফুলের ঝাঁপি হাতে পুজো দিতে যাওয়া কাকিমার সাথে দেখা। ছল ছল চোখে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম কোন কথা হল না।
ঘন্টাখানেক পরে আমাদের উভয় বাড়ির সবাই অল্পক্ষণের জন্য মিলিত হলাম। প্রতীক আমার মুখের দিকে তাকাতেই আমরা উভয়েই কেঁদে ফেললাম। এক দৌড় দিয়ে আমি ছাদে উঠে গেলাম। ছিটকানি লাগিয়ে একা চুপচাপ বসে থাকলাম।কেন দেশভাগ হয়, কেন পূর্বপুরুষ জন্ম-জন্মান্তরের ভিটে বাড়ি ছেড়ে মানুষের চলে যেতে হয় সেসবের আমি কিছুই বুঝিনা। আমি মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ওরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আর নীচে নামিনি। সময়টা ১৯৬৮ সাল।

(পুরানো লেখা ফেসবুক সামনে নিয়ে এলো আজ। লেখাটি সে সময় অনেকের মন স্পর্শ করেছিল।)


লেখক : কবি ও সাবেক সচিব। 

১১৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন