পাবলিক হেলথ ও গ্লোবাল হেলথ-এর দৃষ্টিতে মোরাকাবা

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:৫৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
একবিংশ শতাব্দীর দ্রুতগামী প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতায় মানুষ যত উন্নতির শিখরে পৌঁছাচ্ছে, ততই মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তির গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।
উদ্বেগ, হতাশা, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি আত্মহত্যা—এইসব সমস্যা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত নয়; বরং এগুলো বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের (Global Health) অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা ধ্যান (Meditation) ও mindfulness চর্চাকে একটি বিকল্প ওষুধবিহীন চিকিৎসা বা “non-pharmacological intervention” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই আলোচনায় আমরা দেখব, ইসলামী আধ্যাত্মিক অনুশীলন মোরাকাবা (Muraqabah)—যা আল্লাহর উপস্থিতি অনুভবের মাধ্যমে গভীর মনঃসংযোগের অনুশীলন—কীভাবে আধুনিক Public Health ও Global Health-এর দৃষ্টিকোণ থেকে শরীর ও মনের পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য: এক বৈশ্বিক সংকট-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯৭ কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। উদ্বেগ (Anxiety) ও বিষণ্নতা (Depression) এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ। কোভিড-১৯ মহামারির পর এই হার ২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো—বিশ্বের অনেক দেশে গুরুতর মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ৯০% মানুষ কোনো চিকিৎসাই পান না, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে (WHO, 2023)।
এই প্রেক্ষাপটে মানসিক সুস্থতাকে “Global Health Priority” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। WHO এখন “Self-care, Mindfulness, and Compassion Practices”—কে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে (UN World Mental Health Day, 2024)। ধ্যান তাই এখন ধর্মীয় বা দার্শনিক বিষয় নয়; এটি এক বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত জনস্বাস্থ্য থেরাপি। ধ্যান ও শরীর-মনের বৈজ্ঞানিক পুনরুজ্জীবন-বৈজ্ঞানিকভাবে ধ্যান এমন একটি প্রক্রিয়া, যা শরীরের স্নায়ুতন্ত্র, হরমোন, হৃদযন্ত্র, ঘুম, ইমিউন সিস্টেম এবং মস্তিষ্কের কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
১. স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার-হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ধ্যান করলে মস্তিষ্কের Amygdala (ভয় ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ) ছোট হয় এবং Prefrontal Cortex (যুক্তিবোধ ও আত্মসংযম নিয়ন্ত্রণকারী অংশ) সক্রিয় হয়। ফলে মানুষ চাপের মধ্যেও স্থির থাকতে শেখে।
২. কর্টিসল হ্রাস ও সুখ হরমোন বৃদ্ধি-ধ্যান Cortisol হরমোনের মাত্রা কমায়—যা মানসিক চাপের মূল কারণ। একইসঙ্গে এটি Serotonin ও Endorphin বৃদ্ধি করে, যা আমাদের সুখ ও প্রশান্তির অনুভূতি জাগায় (Harvard, 2019)।
৩. হৃদরোগ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ- American Heart Association (AHA, 2020) জানায়, ধ্যানকারীদের গড় রক্তচাপ ৮–১০ mmHg পর্যন্ত কমে যায়। ধ্যানের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ধকধক কমে, Heart Rate Variability (HRV) উন্নত হয়, এবং রক্তনালীর নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়—যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
৪. ঘুম ও মস্তিষ্কের পুনর্জন্ম- ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, ধ্যান মস্তিষ্কের gray matter density বৃদ্ধি করে, যা শেখা, স্মৃতি ও মনোযোগ বাড়ায়। নিয়মিত ধ্যান অনিদ্রার প্রবণতা ৬০% পর্যন্ত কমাতে সক্ষম (Sleep Research Society, 2021)।
৫.ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালীকরণ- National Center for Complementary and Integrative Health (NCCIH) জানিয়েছে, নিয়মিত ধ্যানকারীদের শরীরে anti-inflammatory cytokine ভারসাম্য রক্ষা পায় এবং ভাইরাস প্রতিরোধী T-cell কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।
৬. নিউরোপ্লাস্টিসিটি ও মস্তিষ্কের পুনর্গঠন-২০১৮ সালে Harvard Medical School জানায়, ধ্যানের ফলে মস্তিষ্কে নতুন স্নায়ু সংযোগ (neural pathways) তৈরি হয়। এটি neuroplasticity বৃদ্ধি করে, ফলে মনোযোগ, আত্মসংযম ও সৃজনশীল চিন্তা শক্তি বৃদ্ধি পায়। গ্লোবাল হেলথে ধ্যানের ভূমিকা- ধ্যান এখন বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছে।
১️. Medical Meditation: আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে এখন “Mindfulness-Based Stress Reduction (MBSR)” প্রোগ্রাম চালু আছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (Johns Hopkins University, 2018) এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধ্যান পদ্ধতি বিষণ্নতা নিরাময়ে ওষুধের মতোই কার্যকর।
২️. Corporate Health Programs: Google, Apple, Microsoft-এর মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় “Mindfulness at Work” প্রোগ্রাম চালু করেছে। এর ফলে কর্মীদের মনোযোগ, সহনশীলতা ও টিমওয়ার্কের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩️. United Nations & WHO Initiatives: জাতিসংঘ ও WHO উভয়েই ধ্যানকে মানবিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। “World Mental Health Day 2024”-এর মূল বার্তায় বলা হয়, “Mindfulness and Compassion are essential for global well-being.”
ইসলামী ও সুফি দৃষ্টিকোণ: মোরাকাবা — আত্মার নিরাময়
ধ্যান বা মনঃসংযোগ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সম্পত্তি নয়। ইসলামেও ধ্যানের এক গভীর ও আধ্যাত্মিক রূপ রয়েছে, যার নাম মোরাকাবা (Muraqabah)।
“মোরাকাবা” শব্দটি আরবি মূল “রাকাবা” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নিরীক্ষণ বা সচেতন পর্যবেক্ষণ। ইসলামী তাসাওফে এটি বোঝায়—আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করা এবং নিজের অন্তরকে সেই উপস্থিতির আলোতে একাগ্র করা।
কুরআনে বলা হয়েছে—“যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান-জমিনের সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা করে।”(সূরা আলে ইমরান: ১৯১)
এই “চিন্তা ও স্মরণ”-ই প্রকৃতপক্ষে ইসলামী ধ্যানের রূপ—যা মনকে কেন্দ্র করে আল্লাহর স্মৃতিতে নিমগ্ন করে।
সুফি দার্শনিক ইমাম আল-গাজ্জালি (রহঃ) তাঁর Ihya Ulum al-Din গ্রন্থে বলেছেন—মোরাকাবা হলো সেই অবস্থা, যেখানে হৃদয় আল্লাহর উপস্থিতিতে স্থির হয়, এবং চিন্তা একমুখী হয়ে যায়। অর্থাৎ এটি এমন এক মননচর্চা, যা মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি দূর করে আত্মাকে শান্ত করে।
১৯০০ শতাব্দীর বিশিষ্ট সুফি সাধক হজরত খাজা নাছের আলী (রহ.) মোরাকাবাকে আত্মজাগরণের সর্বোচ্চ ধাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, মোরাকাবা কেবল ধ্যান নয়, বরং এটি অন্তরের পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার এক বিশেষ আধ্যাত্মিক অনুশীলন। তিনি বলেন, “যে অন্তর মোরাকাবায় নিমগ্ন, সে নিজের মধ্যে রবের আলো প্রত্যক্ষ করে।” খাজা নাছের আলী (রহ.) মোরাকাবাকে হৃদয় ও আত্মার চিকিৎসা হিসেবে দেখেছেন—যেখানে মুরিদ নিজ সত্তার সীমা অতিক্রম করে দেহ, মন ও আত্মাকে আল্লাহর প্রেমে সমর্পণ করে। তাঁর শিক্ষা অনুসারে, নিয়মিত মোরাকাবা মানুষকে জাগতিক উদ্বেগ, ভয় ও হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করে শান্তি, ধৈর্য ও ঈমানের গভীরতা বৃদ্ধি করে।
মোরাকাবার বৈজ্ঞানিক প্রভাব: দেহ-মন-আত্মার সমন্বয়-
১.স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনের ভারসাম্য-মোরাকাবা চলাকালে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস parasympathetic nervous system সক্রিয় করে, ফলে কর্টিসল কমে যায় ও dopamine, serotonin বৃদ্ধি পায়। এটি সুখ, আত্মবিশ্বাস ও স্থিরতা আনে।
২.হৃদরোগ ও রক্তচাপ-American Heart Association (2020) জানায়, ধ্যান অনুশীলন রক্তচাপ গড়ে ৮–১০ mmHg কমাতে পারে। মোরাকাবার ক্ষেত্রে এই উপকারিতা আরও গভীর, কারণ এটি কেবল শারীরিক নয়—আধ্যাত্মিক প্রশান্তির মাধ্যমেও হৃদযন্ত্রে স্বস্তি আনে।
৩.ঘুমের মান উন্নয়ন-
মোরাকাবা melatonin নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, যা ঘুমের মান উন্নত করে। গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত ধ্যান অনুশীলনে ঘুমের মান ৪০% এর বেশি বৃদ্ধি পায়।
৪.ইমিউন সিস্টেমে ইতিবাচক প্রভাব-ধ্যান শরীরে প্রদাহজনিত প্রক্রিয়া কমায় (anti-inflammatory effect)। ফলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, অটোইমিউন রোগ বা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৫.মনোসংযোগ ও আত্ম-সচেতনতা-মোরাকাবা চর্চা মস্তিষ্কের Default Mode Network (DMN) কম সক্রিয় রাখে, ফলে অকারণ চিন্তা বা overthinking হ্রাস পায়। আত্ম-সংযম, নৈতিক সচেতনতা ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি বৃদ্ধি পায়।
৬.আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ-সাইকোলজিস্ট Carl Jung ও William James উভয়েই বলেছেন—ধ্যান মানুষের মধ্যে “Higher Consciousness” জাগিয়ে তোলে। ইসলামী ভাষায় একে বলা হয় “ইহসান”—অর্থাৎ এমনভাবে ইবাদত করা যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো।
মোরাকাবা — মানবতার পুনরুজ্জীবনের পথ
চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন “Holistic Health” বা সার্বিক স্বাস্থ্যের ধারণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে—যেখানে শরীর, মন ও আত্মা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মোরাকাবা এই ত্রয়ী সমন্বয়ের এক অনন্য অনুশীলন। এটি
ওষুধ ছাড়াই মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়া পুনর্গঠন করে, আত্মাকে নৈতিকভাবে জাগ্রত করে। আজকের উদ্বেগময়, প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে মোরাকাবা হতে পারে এক নতুন “Rejuvenation Revolution”—যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজে পাবে, সমাজ পাবে সহমর্মিতার দিশা, আর মানবতা ফিরে পাবে তার হারানো মানসিক ভারসাম্য।
যেমন বলা হয়েছে— When the mind finds peace, the body heals itself. অর্থাৎ মন যখন প্রশান্ত হয়, শরীর তখন নিজেই আরোগ্য লাভ করে।
মোরাকাবা সেই প্রশান্তিরই পথ—যেখানে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, এবং মানুষ তার প্রকৃত সত্তার সন্ধান পায়।
তথ্যসূত্র:
1.World Health Organization (WHO) – Global Health Estimates, 2023,
2.Harvard Medical School – Mindfulness and the Brain, 2018–2019
3.American Heart Association – Meditation and Cardiovascular Health, 2020
4.Johns Hopkins University – Meditation and Depression Meta-analysis, 2018
5.Sleep Research Society – Meditation and Sleep Quality, 2021
6.National Center for Complementary and Integrative Health (NCCIH) – Mindfulness and Immunity, 2022
7.Al-Ghazali, Ihya Ulum al-Din
8.The Holy Qur’an – Surah Al-Imran, Ayah 191
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।
১৪৯ বার পড়া হয়েছে