সর্বশেষ

মতামত

সন্দেহ : জিজ্ঞাসা, জ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির দ্বার

স্বাধীন চৌধুরী
স্বাধীন চৌধুরী

সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:২০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল এক প্রশ্ন থেকে- 'এটা কেন?'
আর প্রতিটি প্রশ্নের জন্মভূমি হলো সন্দেহ।

যখন মানুষ প্রথম আকাশে বিদ্যুৎ দেখেছিল, তখন ভয় পেয়েছিল; যখন দ্বিতীয়বার দেখল, তখন প্রশ্ন করলো- 'এটা কীভাবে ঘটে?'
এই জিজ্ঞাসাই ছিলো বিজ্ঞানের সূচনা, দর্শনের উৎস আর মানুষের মস্তিষ্কের স্বাধীনতার প্রথম স্পন্দন।
আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা, জ্ঞানের বিপুল ভান্ডার, যত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যত দার্শনিক চিন্তা- সবকিছুর পেছনে আছে একটিমাত্র শক্তিঃ সন্দেহের সাহস।

১. সন্দেহের মনস্তাত্ত্বিক বীজঃ

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, সন্দেহ হলো আত্মপর্যালোচনার প্রথম ধাপ।
যা এক ধরনের cognitive dissonance- অর্থাৎ মনের মধ্যে বিরোধী দুটি বিশ্বাস বা ধারণা যখন সংঘাতে আসে, তখন মানুষ নতুন সত্যের সন্ধান করে।
সন্দেহ তাই শুধু ভয় নয় বরং অন্তর্গত প্রশ্নের সাহস।
শিশু যখন জিজ্ঞাসা করে 'আকাশ নীল কেন?', তখন সে সন্দেহ করছে পূর্বধারণাকে।
এই সহজ প্রশ্নই মানবমস্তিষ্কের সবচেয়ে মৌলিক প্রতিক্রিয়া- অন্ধ অনুসরণ নয়, স্বজ্ঞানের পথে যাত্রা।
সন্দেহের এই প্রবণতা যদি দমন করা হয়, তবে জন্ম নেয় অন্ধ আনুগত্য, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও গোঁড়ামি।
আর যদি একে সঠিকভাবে লালন করা যায়, তবে সেটিই হয়ে ওঠে প্রজ্ঞার উৎস।

২. দর্শনের আলোকে সন্দেহঃ

সক্রেটিস ও জিজ্ঞাসার নীতি সম্পর্কে
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন-
'The unexamined life is not worth living.'
অর্থাৎ যে জীবন প্রশ্নহীন, তা বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। সক্রেটিসের শিক্ষা ছিল- সন্দেহ করো, জিজ্ঞাসা করো, আলোচনা করো।
তার শিষ্যরা তাকে বারবার অভিযুক্ত করেছিল 'যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্য,'
কিন্তু সক্রেটিস জানতেন- প্রশ্নের ভেতরেই নিহিত মুক্তি।

ডেকার্টের পদ্ধতিগত সন্দেহঃ

১৭শ শতকে রেনে ডেকার্ট সেই সক্রেটিসীয় প্রশ্নকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন-
'I doubt, therefore I think; I think, therefore I am.'
ডেকার্টের মতে, সন্দেহ মানে অস্তিত্বের প্রমাণ।
সব কিছুকে প্রশ্ন করা উচিত- ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা, এমনকি ঈশ্বর পর্যন্ত- যতক্ষণ না মনের ভেতর এক অখণ্ড সত্য উপলব্ধি হয়।
এই methodic doubt-ই আধুনিক যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের ভিত্তি।

বুদ্ধের বিশ্লেষণঃ

গৌতম বুদ্ধ সন্দেহকে জ্ঞানের সহচর হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন-
'Do not believe because it is said, or because it is written,
but believe only when it agrees with your reason and experience.'
বুদ্ধের এই অবস্থান দেখায়, সন্দেহ এখানে অজ্ঞতার প্রতীক নয়- আত্ম-পরীক্ষার পবিত্র দরজা।

৩. ধর্ম ও বিশ্বাসের সীমানায় সন্দেহঃ

ধর্মীয় পরিসরে সন্দেহকে প্রায়ই নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- মহান নবী- প্রশ্ন করেছেন-
'হে প্রভু, তুমি মৃতকে কীভাবে জীবিত করো?'
ঈশ্বর তার জিজ্ঞাসাকে অবিশ্বাস নয় বরং বিশ্বাসের দৃঢ়তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
খ্রিষ্টান ধর্মে ‘Doubting Thomas’ সেই শিষ্য, যিনি যিশুর পুনরুত্থানে সন্দেহ করেছিলেন।
কিন্তু সেই সন্দেহই বিশ্বাসকে করে তুলেছিল জীবন্ত ও গভীর- কারণ, সন্দেহই বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করে।
রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন-
'বিশ্বাস যদি সত্য হয়, তবে সন্দেহ তাকে ভাঙতে পারে না; সন্দেহই বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণের পথে নিয়ে যায়।'

৪. বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রাঙ্গণে সন্দেহঃ

বিজ্ঞানের ইতিহাস আসলে সন্দেহেরই ইতিহাস।
আরিস্টটল বলেছিলেন-
'Wonder is the beginning of philosophy.'
গ্যালিলিও সন্দেহ করেছিলেন চার্চের ঘোষণাকে;
কোপার্নিকাস সন্দেহ করেছিলেন পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে; ডারউইন সন্দেহ করেছিলেন সৃষ্টিতত্ত্বের অপরিবর্তনীয়তাকে। এই প্রতিটি সন্দেহই মানুষের জ্ঞানের সীমা ভেঙে দিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা কখনো সত্যকে 'চূড়ান্ত' বলেননি- তারা বলেন- 'It works, until proven otherwise.'
অর্থাৎ বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই অবিরাম সন্দেহের চর্চা। শিক্ষাক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য।
একজন শিক্ষক যদি ছাত্রকে সন্দেহ করতে শেখান,
তবে সে মুখস্থ নয়, বোঝার পথে হাঁটবে।
প্রশ্ন করতে শেখানোই প্রকৃত শিক্ষা,
কারণ অন্ধ বিশ্বাসে জ্ঞান জন্মায় না- জন্ম নেয় কেবল অনুকরণ।

৫. সাহিত্য ও শিল্পে সন্দেহের নন্দনচেতনাঃ

শিল্পের ভেতরেও সন্দেহ এক অনিবার্য স্রোত।
শেক্সপিয়রের হ্যামলেট চরিত্র মানুষের মানসিক দ্বন্দ্বেরই প্রতীক-
'To be or not to be, that is the question.'
এ প্রশ্ন কেবল মৃত্যুভয় নয়, এ মানবঅস্তিত্বের অনিশ্চয়তা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান।
রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' কবিতায় সন্দেহের বিপরীতে উঠে এসেছে স্বাধীন চিন্তার আহ্বান-
'যেখানে জ্ঞান মুক্ত, সেখানে মাথা থাকে উঁচু।'
জীবনানন্দের নিঃসঙ্গতা, কিংবা কাফকার অস্তিত্ববাদ- সবকিছুতেই এক গভীর সন্দেহ কাজ করে-
মানুষ কি আদৌ নিজের নিয়ন্ত্রক?
নাকি সে সময় ও প্রেক্ষাপটের দাস?
বাংলা কবিতার আধুনিক ধারায় এই সন্দেহ হয়ে ওঠে আত্মবোধের প্রতীক-
নিজেকে, সমাজকে, প্রেমকে ও ঈশ্বরকে প্রশ্ন করার নান্দনিক সাহস।

৬. সমাজ ও নৈতিকতার আয়নায় সন্দেহঃ

সন্দেহের দুটি দিক আছে-
একটি গঠনমূলক, অন্যটি বিধ্বংসী।
গঠনমূলক সন্দেহ মানুষকে অন্যায়, মিথ্যা ও প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়।
অন্যদিকে, বিধ্বংসী সন্দেহ- যেখানে যুক্তি নয়, ভয় ও অবিশ্বাস কাজ করে-
তা সমাজে বিভাজন, অবিশ্বাস ও সহিংসতা বাড়ায়।
একজন ছাত্র যদি শিক্ষককে সন্দেহ করে জ্ঞানের কারণে- তবে সেটি ইতিবাচক।
কিন্তু যদি সে সন্দেহ করে ঈর্ষা বা অবিশ্বাসে, তবে তা সম্পর্ক ভেঙে দেয়। সন্দেহ তাই একধরনের অস্ত্র, যা জ্ঞানীর হাতে প্রজ্ঞা, অজ্ঞানীর হাতে ধ্বংস।

৭. নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাঃ

সন্দেহকে অতিক্রম করার জন্য চাই বোধ-
যে বোধ প্রশ্ন করে, আবার উত্তর খুঁজেও পায়।
বৌদ্ধ দর্শনে বলা হয়-
'সন্দেহ হলো নদী, আর জ্ঞান হলো অপর পাড়।'
মানুষকে এই নদী পাড়ি দিতে হয় নিজের সাধনা দিয়ে, না হলে সে মাঝপথে আটকে যায়- না বিশ্বাসে, না অবিশ্বাসে।
আধ্যাত্মিক মানুষ সন্দেহকে ভয় পান না বরং একে চেতনার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ, সন্দেহ না থাকলে আত্মোপলব্ধিও অসম্ভব।

৮. সমকালীন প্রেক্ষাপটে সন্দেহের প্রাসঙ্গিকতাঃ

আজকের পৃথিবীতে তথ্যের প্রাচুর্য যেমন বেড়েছে,
তেমনি বেড়েছে ভুয়া বিশ্বাস, প্রোপাগান্ডা ও বিভ্রান্তি। এই সময় সন্দেহের শিক্ষা আরও জরুরি।
কিন্তু এই সন্দেহ যেন নেতিবাচক না হয়-
সন্দেহ যেন সমালোচনামূলক চিন্তা (critical thinking) হয়ে ওঠে।
যে মানুষ যুক্তির আলোয় প্রশ্ন করতে জানে,
সে সহজে বিভ্রান্ত হয় না, সে গড়তে পারে দায়িত্বশীল নাগরিকতা।
একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজন
‘Questioning-based learning’-
যেখানে ছাত্রকে শেখানো হবে কীভাবে সন্দেহ করতে হয়, কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়,
আর কীভাবে সত্য ও মিথ্যা আলাদা করতে হয়।

৯. উপসংহারঃ সন্দেহ থেকে প্রজ্ঞা-

সন্দেহ মানে অন্ধকার নয় বরং আলোর দিকে প্রথম পদক্ষেপ। বিশ্বাস যদি আত্মাকে স্থির করে,
তবে সন্দেহ আত্মাকে জাগ্রত রাখে। যে জাতি প্রশ্ন করতে জানে, সেই জাতিই অগ্রসর হয়; যে জাতি ভয় পায় সন্দেহকে, সে হারায় চিন্তার স্বাধীনতা।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
'বিশ্বাসের মূলে যদি প্রশ্ন না থাকে, তবে সেই বিশ্বাস মূর্খতার সমান।'
তাই সন্দেহকে ভয় নয়, শ্রদ্ধা করতে হবে- কারণ এই সন্দেহই মানুষকে অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয়, বিশ্বাসের খাঁচা থেকে মুক্ত চিন্তার আকাশে পৌঁছে দেয়।

সন্দেহ আমাদের শত্রু নয়,বন্ধু, পরম শিক্ষক। যে প্রশ্ন করে, অস্বস্তি দেয়, কিন্তু শেষে সে সত্যের মুখ দেখায়। যে মানুষ সন্দেহকে ভালোবাসে, সে-ই শেষ পর্যন্ত জানে- সন্দেহের ভেতরেই লুকিয়ে আছে জ্ঞানের প্রথম আলো।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

১৭৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন