মানবতার আলোয় দীপ্ত সাধক শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:)

বৃহস্পতিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৩:৫০ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এমন এক অনন্য নাম, যার জীবনধারা, শিক্ষা ও কর্মধারা যুগে যুগে মানবতার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে।
তিনি ছিলেন কেবল একজন আধ্যাত্মিক সাধক নন, ছিলেন সমাজসংস্কারক, মানবতাবাদী ও নৈতিকতার পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবন ছিল কুরআনের আলোয় আলোকিত এবং তাঁর চরিত্র ছিল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ দ্বারা গঠিত।
খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এর শিক্ষা ছিল সহজ, স্পষ্ট এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য। তিনি কখনো জটিল দার্শনিক পরিভাষায় মানুষকে বিভ্রান্ত করেননি; বরং গ্রামীণ সাধারণ মানুষ যাতে সহজে আল্লাহর বাণী অনুধাবন করতে পারে, সেই ভাষাতেই তিনি তাওহীদের বার্তা প্রচার করতেন। তাঁর শিক্ষার ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর—তাওহীদের দৃঢ় বিশ্বাস, আখলাকের উৎকর্ষতা এবং মানবসেবা।
তিনি মানুষকে শেখাতেন—“আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে মাথা নত করা যাবে না।” সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম চরিত্রই একজন মানুষের প্রকৃত সম্পদ। তাঁর মতে, দরিদ্র, এতিম, বিধবা ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত ইবাদত। তিনি বারবার বলতেন—“মানুষের মন জয় করাই সর্বোচ্চ সাধনা।”
খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) তাঁর সময়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়া অজ্ঞতা, কুসংস্কার, কুফরি, জুয়া, মদ্যপান ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি মানুষকে মুক্ত করেন অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল থেকে এবং আহ্বান জানান জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে। তরুণ সমাজকে আহ্বান করেন আল্লাহভীতি, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির পথে। নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পারিবারিক জীবনে দায়িত্বশীলতা এবং সামাজিক ঐক্যের ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। কৃষিজীবী সাধারণ মানুষকে তিনি শিখিয়েছেন সততা, সহযোগিতা ও পরিশ্রমের মর্যাদা। এভাবেই তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন হেদায়েতের আলো।
মানবিকতা ছিল তাঁর জীবনের মূল দর্শন। তাঁর দরবার ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত—ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান; তাকওয়াই একমাত্র মর্যাদার মাপকাঠি। তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনা সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি কখনো কোনো অভাবীর আবেদন ফিরিয়ে দেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অদম্য, শাসকের অন্যায্য কর্মে তিনি কখনো সমর্থন দেননি। তাঁর কণ্ঠ ছিল সত্যের পক্ষে দৃঢ় ও নির্ভীক।
তাঁর তাসাউফ ছিল শুদ্ধ কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক—একটি আত্মজাগরণমূলক তাসাউফ। তাঁর শিক্ষা ছিল—অন্তর পরিশুদ্ধ না হলে বাহ্যিক ইবাদতের কোনো মূল্য নেই। তিনি ভক্তদের বলতেন—“অহংকার ত্যাগ করো, রিয়া থেকে মুক্ত হও, জিকিরের মাধ্যমে অন্তরকে আল্লাহমুখী করো।” তাঁর এই দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক, যখন মানুষ ভোগবাদে নিমজ্জিত হয়ে আত্মিক শান্তি হারিয়ে ফেলছে।
আজকের সমাজে যখন দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, স্বার্থপরতা ও সহিংসতা মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে, তখন খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এর শিক্ষা আমাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। তাঁর মানবসেবার আদর্শ আমাদের শেখায় পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার পথ। তাঁর আখলাক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমেই সমাজে স্থিতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
তিনি ছিলেন এমন এক সুফি সাধক, যিনি কেবল দরবারে বসে তসবিহ গোনা সাধক নন; বরং মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে নিজেকে নিবেদিত রাখতেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল এক বাস্তবধর্মী তাসাউফের প্রতিচ্ছবি, যেখানে আধ্যাত্মিকতা মানে ছিল—মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।
তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়েও তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ থেমে যায়নি। তাঁর শরীরিক জীবনের অন্তিম বাণীতেও তিনি কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক নৈতিকতা ও মানবিকতার দীক্ষা প্রচার ও প্রসারের ওসিয়াত রেখে যান। তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত তাঁর সাধক ও আধ্যাত্মিক পুত্র হজরত খাজা নাছের আলী (রহ:), দৌহিত্র বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মাদ ইসমাইল (দা:বা:) এবং প্রপৌত্র খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী-র মাধ্যমে।
এই বংশপরম্পরায় তাঁর নীতি-আদর্শ, আখলাক ও তাসাউফের শিক্ষা আজও আলোকবর্তিকার মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের মাধ্যমে শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) এর প্রদর্শিত মানবতার আলো আজও অম্লান, আজও মানুষের অন্তরে হেদায়েতের প্রদীপ প্রজ্বলিত করছে।
তিনি ছিলেন এক অনন্য সাধক—যিনি নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সমাজের আত্মাকে জাগ্রত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই মহৎ আলোকবর্তিকা, যার আলো কেবল তাঁর যুগেই নয়, আজও মানবতার আকাশে দীপ্তমান। তাঁর শিক্ষা, তাসাউফ ও মানবসেবার দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের প্রকৃত মর্যাদা তাকওয়া, আখলাক ও মানবিকতায়।
এই কারণেই শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দিন (রহ:) শুধু এক যুগের সাধক নন—তিনি চিরন্তন হেদায়েতের প্রতীক, মানবতার এক শাশ্বত আলো, যাঁর প্রদীপ্ত শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের অন্তরকে আলোকিত করে যাবে।
১২১ বার পড়া হয়েছে