কে বাঁশী বাজায় তপ্ত দুপুরে, নির্জন পাহাড়ে

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
লেখাটি কল্পকাহিনী বা বানানো গল্প নয়, ১০০% সত্য কথা যার পেছনে লুকিয়ে আছে সেনাসদস্যদের হাজারও আত্মত্যাগ ও আর্তনাদের কথা এবং তাদের সেই সে আত্মত্যাগের পেছনে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের ছিল বলেই আজ আপনারা সাজেকের মতো ভয়ংকর জায়গায় যেয়ে সেল্ফি তুলতে পারেন।
লেখাটি তৎকালীন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইউসুফ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) আবদুল্লাহ আল ইউসুফের নিজের জীবন থেকে লেখা…….দয়া করে পড়ুন এবং জানুন—-দেশের জন্য সেনাবাহিনী বিরত্বগাথা কিছু কথা, তবে এ কাহিনী হাজারও অজানা কাহিনীর একটি কাহিনী মাত্র। (ইউসুফ স্যারের লেখাটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো)
এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ। ৭৬ হতে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৯ বছর। কিভাবে আমরা দেশের অখন্ডতা ধরে রেখেছি জানুন.....
কে বাঁশী বাজায় তপ্ত দুপুরে, নির্জন পাহাড়ে?
১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে আমরা দুই এল পি অর্থাৎ লাল্লু পাঞ্জু, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইউসুফ আর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গৌতম, বাঘাইহাটে ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে জয়েন করলাম। সেসময়ে সিনিয়ররা আদর করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্টদের লাল্লু পাঞ্জু বলে ডাকতেন।
এল পিজ বলেই শুরুর দিনগুলোতে আমাদের কোন ক্যাম্পের কমান্ড দেয়া হলো না। আমাদের প্রতিদিনের রুটিন কাজ বাঘাইহাট থেকে দীঘিনালার রাস্তার মাঝ দূরত্ব পর্যন্ত রুট প্রটেকশন লাগানো। বাকী অর্ধেক রুট প্রটেকশন লাগাতো ৬ ইষ্ট বেঙ্গল।
'রুট প্রটেকশন' অর্থ চলাচলের রাস্তাকে প্রটেক্ট করা বা সুরক্ষিত রাখা। রাস্তা বলতে অবশ্য মেঠোপথ। তখন ওখানে পীচঢালা বা কংক্রিটের রাস্তা তো ঢের দূরের কথা, এমনকি ইট বিছানো রাস্তাও ছিল না। চড়াই উৎরাই মাড়িয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠা সাপের মতো প্যাঁচানো আঁকা বাঁকা একটা পায়ে হাটা রাস্তা ফরেষ্টের কিছু ডোজার দিয়ে একটু প্রশস্ত করা হয়েছে শুধু।
ঐ পথে তখন আর্মির গাড়ী আর ফরেষ্টের ডোজার ছাড়া ক্বদাচিত দু'একটা চান্দের গাড়ী আর পঙ্খীরাজ চলাচল করতো শুধু। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তাটা একহাটু প্যাঁচপেঁচে কাদার নদীতে পরিনত হতো। গাড়ীগুলো ফেসে যেতো। সেগুলোকে টেনে, ঠেলে তোলাও ছিল আরেক ঝক্কি। এই রাস্তাটা ছিল আমাদের জন্য ভয়ংকর এক ডেথ ট্র্যাপ। সেটা নিয়ে পরের পর্বে লিখবো।
রাতের বেলায় এই রাস্তায় কোন চলাচল হতো না। দিনের বেলা জুমিয়া, হাটুরে আর দিনমজুর পায়ে হেটে অথবা চান্দের গাড়ী কিম্বা পঙ্খীরাজে চলাচল করতো। ওদের এই চলাচলকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যই রুট প্রটেকশন।
রাস্তার ধারে উচু উচু পাহাড়ের চুড়োয় প্রহরা চৌকি। প্রতি চৌকিতে পাঁচ থেকে ছ'জন সশস্ত্র সৈনিক থাকতো। আমরা একজন সকালে পেট্রোল নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। পুরো এলাকা সার্চ করে চৌকিগুলোতে টিমগুলোকে তুলে দিয়ে আসতাম। অন্যজন সন্ধ্যার আগে গিয়ে আবার টিমগুলো নামিয়ে নিয়ে আসতাম।
পরদিন ভোরে গৌতমের রুট প্রটেকশন নিয়ে বেড়োবার কথা, বিকেলে আমি নামিয়ে নিয়ে আসবো। গৌতম তাই আর্লি শুয়ে পড়েছে। আমি অনেক রাত জেগে পড়াশোনা করলাম। সামনে বেসিক কোর্স, প্রিপারেশন নিচ্ছি।
ভোরে চীৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। রানার এসে বলল, স্যার, গৌতম স্যারের পেট্রোলে শান্তিবাহিনী অ্যাম্বুশ করসে। আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। গৌতম কি গুলি খেয়েছে? গৌতম কি আর নেই? গত পরশু রাতে গৌতম পড়তে বসে চেয়ারে হা করে ঘুমাচ্ছিল। আমি স্যামসন মিকচার (তামাক) ওর হা করা মুখে ঢুকিয়ে পালিয়ে গেসি। ও মশারী ষ্ট্যান্ড নিয়ে আমাকে তাড়া করসে। সেই গৌতম, হীলের বিপদসংকুল জীবনে আমার সবচে' কাছের বন্ধুটি নেই!
আমি যে কিভাবে একমিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ইউনিফর্ম, জাঙ্গল শু, ব্যান্ডুলিয়ার পড়ে লোডেড এস এম জি হাতে ছুটে গিয়ে চলতে শুরু করা পিক আপটার পেছনে লাফিয়ে উঠলাম, আজ ভেবে অবাক হই। ঐসব মুহূর্তে রিফ্লেক্স বিদ্যুতের মতো কাজ করে।
অকুস্থলে পৌঁছে গৌতমকে পেলাম না। ও গুলি খায়নি। ও পেট্রোল নিয়ে কাউন্টার অ্যাম্বুশ ড্রিল ফলো করে সন্ত্রাসীদের পিছু নিয়েছে। যে পোষ্টটার উপর সন্ত্রাসীরা ফায়ার করেছে, সেখানে পরে আছে একটি নিথর দেহ, ল্যান্স নায়েক আরজান আলী, আনসারের সৈনিক।
ওরা অদূরেই আরেকটা পাহাড়ের চূড়া থেকে এল এম জি ফিক্সড লাইনে রেখে ফায়ার করেছে। একবারই ফায়ার করার সুযোগ পেয়েছে ওরা। সাথে সাথে গৌতমের পেট্রোল রিয়্যাক্ট করসে। দ্বিতীয়বার ফায়ার করার সুযোগ আর পায়নি ওরা। পোষ্টের পাঁচজন সৈনিকের মধ্যে শুধু একজনই গুলিবিদ্ধ হয়েছে, আরজান আলী।
শুধু একটা বুলেট। কিন্তু লেগেছে ক্রিটিক্যাল জায়গায়। উরুতে একটা মোটা ধমনী ছিড়ে বেড়িয়ে গেছে বুলেটটা। ফলে তাৎক্ষণিক ব্যাপক রক্তপাতের কারনে মোটে তিন মিনিটের মধ্যেই মারা গেছে আরজান আলী।
আজ তোমরা যারা দলবেধে সাজেক বেড়াতে যাও, রীল তৈরী করে ফেসবুকে আপলোড করো, পাহাড়ে মানবাধিকার নিয়ে পণ্ডিতের মতো বক্তব্য বিবৃতি দাও, বুঝে না বুঝে পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবী জানাও, তোমরা তো ঐ পথ ধরেই যাও। ঐ পথ, যার প্রতিটি ধুলিকণা পবিত্র হয়েছে এমন অসংখ্য আরজান আলীদের রক্তে।
ওরা বুকের পাঁজর দিয়ে এই মাটিকে আগলে না রাখলে তোমাদের আর সাজেক পর্যন্ত পৌছাতে হতো না। তার আগেই সন্ত্রাসীরা তোমাদের কেটে টুকরো টুকরো করে চেঙ্গী কিম্বা কাসালং এর পানিতে ভাসিয়ে দিতো।
খুব সুন্দর বাঁশী বাজাতো আরজান আলী। গুমোট, বিষন্ন দুপুরে, গনগনে ঢেউ খেলানো রোদ্দুরে অনেক অনেক দূর ভেসে যেতো সেই বাঁশীর বিষন্ন সুর। আজও চোখ বুজলে ওর বাঁশীর সূর শুনতে পাই।
(লেখায় ব্যবহৃত ছবি খাগড়াছড়িতে কোন এক স্পেশাল অপারেশনের যাওয়ার পথে তোলা)
লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
১৪১ বার পড়া হয়েছে