গাউসুর রহমান : কবিতার বরপুত্র

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:০২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিশ্বযুদ্ধোত্তর তিরিশিয় কবিতার পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রবর্তিত প্রকৃতি, মানবমন, ফ্লয়েডীয় মনোঃ বিশ্লেষণ ইত্যাদি -র দেওয়া-নেওয়া জারি রেখে আধুনিক কবিগণ আরাধ্য -আধারে সমর্পিত। এর সুদূর প্রসারী প্রভাব চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাটের কবিতায় লক্ষ্যণীয়।
কবিতার আশির দশক সরলার্থে এসবের সম্প্রসারণ- বিষয় ও প্রকরণে, তার অন্বেষণে এবং নীরিক্ষায় আশির দশকের কবিগণ নতুন ইশতেহার পাঠকের জ্ঞাতার্থে সম্পন্ন করেছেন।
গাউসুর রহমান আশির দশকের কবি। জীবন ওলট-পালট করা রক্তের আখরে লেখা কবিতার কবি। রক্তের আখরে লেখা কবিতার কবি। শব্দচয়নে পংক্তির গূঢ় এষণার ভাবনার বহুস্তর মাত্রিকতার অনন্য উদাহরণ তাঁর কবিতা।
দার্শনিক নোয়াম চমস্কি, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান, এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্য জিজ্ঞাসা এবং নয়া ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার সঙ্গে সবিকলপ অভীপ্সায় উজান হলের অভিমুখে তাঁর যাত্রাপথ চিহ্নিত। আশির দশকের পুরঃসর কারভাঁয় গাউসুর রহমান বিশিষ্ট হয়ে আছেন।
নয়া ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থার ধনীদেশের বিভিন্ন ট্যারিফ আরোপ, উত্তর-দক্ষিণ বিশ্ব বৈষম্য এবং পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের খামখেয়ালিপনায় ঋণচক্রে পতিত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ তাদের কাঁচামালের সরবরাহ এবং শ্রমশক্তির দাসত্বে জাতীয় স্বাধীনতা এবং এমন টুটাফাটা দশায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বিসর্জন দিয়ে চলছে।
নোয়াম চমস্কি এমন বৈষম্যের অধিক্ষেত্রে তাঁর মতামত স্পষ্ট করে বলেছেন-
‘ গরিব দেশ বলে কিছু নেই - আছে কেবল সম্পদের ব্যর্থ ব্যবস্থাপনা, যেখানে ধন লুকিয়ে থাকে, কিন্তু হাত বাড়াতে পারে না সাধারণ মানুষ।’
অন্যত্র চমস্কি বলেছেন–
‘ ইতিহাস ফিসফিস করে বলে-
অধিকার দেওয়া হয় না,
ছিনিয়ে নিতে হয় শক্তির দাঁতে-নখে।’’
রাজনীতি সচেতন, দার্শনিক ভাবনায় সান্দ্র কবিকণ্ঠ গাউসুর রহমান পুরো আশির দশকে যেরূপ প্রকাশিত ছিলেন, পরিবর্তনের রসমের-রেওয়াজ সম্মুখে আনয়নে বিশিষ্ট চিন্তায় চিহ্নিত হন। ‘এখন আর আমি ভুলেও হেঁটে যাই না/উচ্ছ্বলিত রোদে/ আমার নির্জন চোখেও নীলিমা থাকে না,/ পৃথিবীর উৎকণ্ঠিত ভিড়ে -/আমি এক অসহায় মানব।’
(‘মেঘের অন্ধকার’)
'জটিল তারের জালে/ আটকে গেছে আমার সময়’, (‘মূঢ়তার দিন শেষ হয় না আর’)
মানুষের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস হারান না কবি গাউসুর রহমান। 'মানুষ এখন জননট হয়ে নাচে/ মানুষ আবছায়া অবক্ষয়ে থাকে’
(জোনাকির নীল কোলাহলে নেই)
এমন বয়ানের পর আবার অন্য এক কবিতায় বলেন পর অ সাবার বলেন-
'পাতালের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে নীল নীল মরুভূমি/
রমণীর ছায়াচোখ পুরুষের চোখে চোখ রেখে/ হয়ে ওঠে সুন্দর আরঙ।/ পাতালের দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের জ্যোৎস্না।’’
(ফুলের জ্যোৎস্না')
'বাবা'- তিনি শুধু জনকই নন। তাকে বলা যায়, জাগতিক পৃথিবীর অনেক জিজ্ঞাসার সারিবদ্ধ ইচ্ছের কথা। গাউসুর রহমান বাবা সিরিজে এমন অনেক জীবন-জগতের এমন অনেক জিজ্ঞাসা উপস্থাপিত করেছেন। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ও নোয়াম চমস্কি যার নিকট প্রতিবেশী। বাবা সিরিজের শিরোনাম –
‘বাবা, পৃথিবীর মানুষ এখন হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়’, 'বাবা, পৃথিবীর মানুষ নীল আকাশ দেখে না’, 'বাবা, পৃথিবীর আকাশ কালোর গিয়ে মিশে’’,বাবা এক সোনালি রোদের নাম,’ বাবা ও মেঘশিশিরের জল’
‘বাবা, সহিষ্ণু নিভৃতে আছি’,‘ বাবা, পৃথিবীতে সকলি ফুরায় অতল সনাতনে’ ‘বাবা, আমার স্নায়ুতে থাকে প্রতিনিয়ত অন্ধকার’ ‘বাবা, পৃথিবীতে থাকি ভ্রান্তিবশত’’, ‘পিতা, মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রে তোমার গলার আওয়াজ শুনতে পাই’, ‘ বাবা, পৃথিবী সুধার মরুভূমি’’, ‘আমাদের শহরে বাবা থাকেন না’, ‘বাবা ও পৃথিবীর নীল আকাশ’’, ‘ বাবা থাকেন স্তব্ধতার দেশে’
‘বাবা, পৃথিবীর কতো কতো পথ মুছে গেছে’
, ‘বাবা, পৃথিবীর উৎকণ্ঠিত ভিড়ে আছি’’, ‘বাবা, চাঁদের আকাশ পৃথিবী ঢেকে রাখে না’’, ‘বাবা, ঘুমের ভেতর যে ঘুমে তুমি থাকো’, ‘বাবা, জানি মরণের ঘুম ভাঙে না’’,
‘বাবা, জেগে থাকাই কি জীবন’’, ইত্যাদি।
গভীর অতলে ভাবনায় শিস দেয়া লাল জবাটি যখন মেলে দেয় সৌন্দর্যের বৈদূর্যমণি তখন পদাবলি প্রজাপতির বহু বিচিত্র রঙে পাখনা মেলে দেয়। যা বাঙময় হয়ে উঠে প্রতীকায়িত অনুচিন্তনে। কোনো এক প্রত্যূষে কবি বলেছিলেন- 'কার কারণে এই উপবাস বিশ বছরের/রক্ত এমন লেগে আছে হাতের তলায়!'
'মানুষের মনে বিস্ময় নেই’ বলে গাউসুর রহমান যাপিত জীবনের এক কোণে আলো ফেলে দেখেন- 'আহা! জীবন-/এক জনমের ভুল।' ('হৃদয়ের নামতা') 'নিখিল নাস্তি'র জয়গান করা সুধীন্দ্রীয় জগত গাউসুরের আরাধ্য মনে হতে পারে। আবার প্রেমে বিশ্বাস, মানুষে মানুষে মৈত্রী-উল্লাস-তবে কী গাউসুর রহমানকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উপলব্ধ বিশ্বাসে প্রতিস্থাপিত করে? সুধীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন- 'দিনে দিনে নিজেকে যত চিনছি, তত বুঝছি যে সংসার আমার বৈরী নয়, বহির্জগৎ সুন্দর ও অতিথিবৎসল।'
'আকাশে জ্যোৎস্না/তবুও আমার মনের ভেতর অন্ধকার।/ তবুও আমি বিপুল মেঘের কিনারে।'
('কাল নিরবধি')
'আকাশে জ্যোৎস্না' দেখার কবি 'বিপুল মেঘের কিনারে' থেকে আর যাই হোক বহির্জগতের সুন্দরতম দিনের কাফেলায় না হোক একাকী নির্জন ভ্রমণে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার এক অভিযাত্রী- তিনি কি নন?
গাউসুর রহমানের কবিতার সাত সমুদ্র তের নদীর সুবিস্তৃত অঞ্চল- কাব্য সম্ভার- মায়াবিনী নক্ষত্রের পাখি, ঝিনুকে নেই মুক্তো, তাস খেলা পাশা খেলা, ভালোবাসার পকেট খালি থাকে না, হেঁটে আসে তোমার অন্তর, এই হাতে বীনা বাজে না, সমুদ্রে নোনা জলে তোমার ভালোবাসা, তোমার ছায়ারা হাঁটে আমার পিছু, যার গলনালিতে মৃত্যুর ধুতরা বীজ, মেঘ বৃষ্টিতে প্রেমের ঘোর, যে হৃদয় শরণার্থী চিরকাল, পূর্ব মেঘে বৃষ্টির রঙ, দুঃখগুলো ফিরে আসে আপন ভিলায়, তোমার হৃদয়ের সংবাদদাতা, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থসমূহ।
লেখক: আশির দশকের কবি
২৫১ বার পড়া হয়েছে