অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদে ব্যর্থ সরকার, দেড় দশকেও হয়নি কার্যকর উদ্যোগ

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সড়কগুলোতে বিপজ্জনক হারে বেড়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা। সরকারি ঘোষণা ও সিদ্ধান্তের পরও এসব যান উচ্ছেদে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।
বিগত ১৫ বছরেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কার্যকর কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সীমিত পরিসরে অভিযান শুরু করলেও তা শ্রমিক-মালিক সংগঠনের বাধায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
৭০ লাখ অবৈধ তিন চাকার যান, ৪৬% বৈধ যানও মেয়াদোত্তীর্ণ
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানায়, দেশে বৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬৪.৫ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহন মাত্র ২%। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো—এই বৈধ যানবাহনের প্রায় ৪৬%-ই মেয়াদোত্তীর্ণ বা রাস্তায় চলার অনুপযোগী।
অন্যদিকে সরকারের তথ্যমতে, তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ‘পাখি’। এসব যান কাঠামোগত ও কারিগরি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার বাড়ছে।
দুর্ঘটনায় প্রাণহানি: তিন চাকার যানে নিহত ১,৭২৩ জন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭,২৯৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি—২,৬০৯ জন নিহত হয়েছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১,৭২৩ জন নিহত হয়েছেন তিন চাকার যানে ভ্রমণকালে, যা মোট নিহতের ২৩.৬১%। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩,৭৪১ জন। তিন চাকার ছোট যানে নিহত হয়েছেন ৭৮৬ জন, যা প্রায় ২১%।
বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের দ্বৈত ভূমিকা
তিন চাকার যানবাহন বন্ধে সবসময় সোচ্চার থাকে বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিন্তু যখন প্রশ্ন আসে পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বাস-ট্রাক উচ্ছেদের, তখন তারাই ধর্মঘট ডেকে সরকারের অভিযান ব্যাহত করে।
গত ২০ জুলাই শুরু হওয়া অভিযানেও দেখা যায়, মাত্র ৫১টি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন জব্দ করতে পারে বিআরটিএ। এরপর ২৮ জুলাই ধর্মঘটের হুমকি আসে শ্রমিক সংগঠন থেকে। সরকারের সঙ্গে বৈঠকে কিছু দাবি মানার শর্তে ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়, কিন্তু অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে।
সরকারের আশ্বাস ও উদ্যোগ: ঋণ, নীতিমালা, আমদানিনীতি সংশোধন
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক বলেন, “অভিযান বন্ধ হয়নি, তবে বেশি পুরোনো যান আগে ধরা হচ্ছে, ধাপে ধাপে সব ধরা হবে।” সরকার পরিবহন মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে তারা পুরোনো যানবাহন বদলে নতুন বাস-ট্রাক কিনতে পারে। পাশাপাশি আমদানিনীতিতে পরিবর্তন এনে ৫ বছরের পুরোনো বাসের বদলে ৭ বছরের পুরোনো বাস আমদানির চিন্তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে।
নীতিমালাহীনতা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব
এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই যে, কোন রাস্তায় কতগুলো তিন চাকার যান চলবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নীতিমালার খসড়া তৈরি করলেও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিটি সড়ক নিরাপত্তা সভায় মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, “এই যানের সংখ্যা যত, তা হঠাৎ বন্ধ করা অসম্ভব। বরং কারিগরি মান উন্নয়ন, সুনির্দিষ্ট রুটভিত্তিক নীতিমালার আওতায় আনা দরকার।” নছিমন, করিমন থেকে শুরু করে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস—সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন উচ্ছেদে সিদ্ধান্ত বহুবার হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রতিবন্ধকতা এবং বিকল্প না থাকায় কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে চড়ছে, বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি—কিন্তু সড়ক যেন সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
১০৭ বার পড়া হয়েছে