সর্বশেষ

মতামত

কূটনৈতিক চাপের মুখে ইসরায়েল—ফ্রিডম ফ্লোটিলার অভিযান এখন ইতিহাস

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

শনিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:১১ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো 'গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা' অভিযান। বছরের পর বছর ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধ ভেঙে গাজায় সরাসরি মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর আন্তর্জাতিক এই প্রচেষ্টা বিশ্বের নানা প্রান্তের শত শত মানবিক কর্মী, আইনপ্রণেতা ও সাংবাদিকদের একত্র করেছে।

ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপ, বিশ্ব রাজনীতির প্রতিক্রিয়া, এবং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে।

গাজার দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ ভেঙে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ অভিযানের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত একের পর এক নৌযানে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপ, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা মিলিয়ে ৪৪টি দেশের স্বেচ্ছাসেবী, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিক নিয়ে পাড়ি দেয় যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার উদ্দেশ্যে।

ইতিহাস ও সময়ে সময়ে ঘটনার সংক্ষেপ
'ফ্রিডম ফ্লোটিলা' নামক এই অভিযান ২০০৮ সালে শুরু হয়। তখন দুইটি ছোট নৌকা সাইপ্রাস থেকে গাজা উপত্যকায় পৌঁছে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছিল। ২০১০ সালে সবচেয়ে আলোচিত ‘মাভি মারমারা’ ফ্লোটিলা অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১০ জন নিহত হয় ও বহু মানুষ আহত হন, বিষয়টি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আলোচনায় চরম বিতর্ক তৈরি করেছিল। এরপর প্রায় প্রতিবছরই নানা ছোট-বড় অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনী নৌকাগুলোকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দিয়েছে, এক্টিভিস্টদের আটক করেছে, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো বন্ধ করেছে।

২০২৫ সালের এবারের অভিযানের বিশেষত্ব—“Sumud Flotilla” নামক ৪৪টি ছোট-বড় নৌকা এবং প্রায় ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক, সাংসদ, মানবাধিকার কর্মী, বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক, পরিবেশবাদী এমনকি জলবায়ুকর্মী Greta Thunberg-এর মতো আন্তর্জাতিক তারকাও। গন্তব্য—গাজা উপত্যকায় অবরুদ্ধ লক্ষাধিক মানুষের জন্য সরাসরি মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।

আর্তমানবতার বার্তা ও সহায়তার ধরন
এই বহরে ছিল চাল, আটা, ঔষধ, শিশু খাদ্য, খেলনা, ফার্স্ট এইড সহ নানামুখী জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী; সাথে চিকিৎসক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী—মোট প্রায় ১০০ জন। সংগঠক এফএফসি জানায়, গাজার সঙ্কটে জরুরি প্রয়োজন পূরণই এ অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য।

চরম মানবিক বিপর্যয়: সাহায্য প্রবেশে পরিকল্পিত বাধা
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ ও লাগাতার সামরিক অভিযানের ফলে বর্তমানে সেখানে এক চরম মানবিক বিপর্যয় চলছে—জাতিসংঘ, শিশু সংস্থা, ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে ইসরায়েল বাধ্যতামূলক অবরোধ চাপিয়ে দিয়ে খাদ্য, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি, ও জ্বালানিসহ ন্যূনতম জীবনরক্ষাকারী সরবরাহও প্রবলভাবে সীমিত করেছে; ফলে নারী, বিশেষত শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও মৌলিক চাহিদার অভাবে মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী, স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং হাসপাতালগুলো বন্ধ বা অকেজো হয়ে পড়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্পষ্টভাবে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতে তুলে ধরেছে; গণকবর, নিখোঁজ ও ক্ষুধার্ত শিশুর ছবি বিশ্ব জনমতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শিশুর সংখ্যা ও নারী-নির্যাতনের হার এত বেড়েছে যে আন্তর্জাতিক চাপ ও নিন্দা আরও তীব্র হয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধ ও দখলদারনীতি স্থবিরই রয়ে গেছে, ফলে দুর্ভিক্ষ-সাম্যহীনতা নিয়ে গাজা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের প্রতীক।

অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ
এই মানবিক ফ্লোটিলা-তে অংশ নিয়েছে ৪০টির বেশি দেশ—স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, আইরল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, টার্কি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, বাংলাদেশসহ বহু দেশের সংসদ সদস্য, এক্টিভিস্ট, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক. গ্লোবাল দক্ষিণ এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ থেকেও প্রতিনিধিত্ব করছেন।

বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
অভিযান শুরুর পরপরই ইসরায়েলি নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় কঠোর অভিযান চালিয়ে একে একে প্রায় সব নৌযান জব্দ করে। আটক করা হয়েছে অংশগ্রহণকারীদের। দেশে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া চলছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রীয়ভাবে একে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ ও ‘উস্কানি’ বলে জানায়। বিপরীতে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, তুরস্কসহ বহু দেশ চালাবে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার, কঠোর বিবৃতি এবং ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ।

বিশেষভাবে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো দেশের নাগরিকদের আটকের প্রতিবাদে ১ অক্টোবর ইসরায়েলের কূটনৈতিক প্রতিনিধি বহিষ্কার করেন এবং দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন। এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নজিরবিহীন।

ইতালির সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি
ইতালির সংসদ সদস্য Arturo Scotto, Marco Croatti, Annalisa Corrado, Benedetta Scuderi যাত্রায় সরাসরি অংশ নেন। ইতালীয় সরকার তাঁদের মুক্তির জন্য নৌ-সাহায্যও পাঠায়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম ছিলেন ‘Conscience’ গ্রুপের ফ্লোটিলা সদস্য।

২ অক্টোবর দুপুরে শহিদুল সহ ৮টি নৌযান গাজা জলসীমা অতিক্রমের জন্য এগিয়ে যান, কিন্তু ইসরায়েলি সেনা বাধা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হন। শহিদুল আলম থেমে যাননি—ভিডিও বার্তা ও সাংবাদিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানান, বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে শান্তিমিশনে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং গাজার মানুষের পাশে আছেন।

ইউরোপ ও আরব বিশ্বের উত্তাল প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের পর ইউরোপ, আরব বিশ্ব, ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে হাজার হাজার মানুষ গাজা সংহতিতে সড়কে নামেন। বার্লিন, প্যারিস, জেনেভা, ডাবলিনসহ বহু শহরে বিক্ষোভ চলে. ফ্রিডম ফ্লোটিলা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে—মানবাধিকার, মুক্তিযুদ্ধ, বৈশ্বিক সংহতির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়।

ইসরায়েল ফ্রিডম ফ্লোটিলা আটকানোর পরপরই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শহর—বিশেষত বার্লিন, প্যারিস, ডাবলিন ও জেনেভা—ছাড়াও স্পেন, ব্রাজিল, তুরস্ক, ইতালি, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, কিউবা, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও আরব বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে; তারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সংহতি, মানবিক সহায়তা আটকে দেওয়ার প্রতিবাদ এবং ইসরায়েলি আচরণের নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন বিক্ষোভ, গণসমাবেশ ও পদযাত্রায় অংশ নেয়।

শেষ কথা
ফ্রিডম ফ্লোটিলা ২০২৫-এর গাজা-মুখী অভিযান এখন বৈশ্বিক মানবিক সংহতি ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল নজির। ২৮ সেপ্টেম্বর–৩ অক্টোবর সময়কালে এই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বরাজনীতির মানচিত্রে মানবতার ছাপ রেখে চলেছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি শহিদুল আলম সক্রিয় থেকেছেন, ইতালির সংসদ সদস্যদের কূটনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে, কলম্বিয়া সরাসরি ইসরায়েলের বিরোধিতা করেছে—আর বিশ্বের বহু দেশ শান্তিপূর্ণ মানবাধিকার, সংহতি ও দায়িত্ববান নাগরিক সমাজের কণ্ঠ তুলে ধরেছে, গাজা উপত্যকার বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এই অভিযান সপ্তার শেষে গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ, গণসংহতি ও মানবতাবাদের অনন্য দলিল হয়ে থাকবে।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৯১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন