পন্ডিতমশাইয়ের স্মৃতি

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৪:৪১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
১৯৬৭ সালে ক্লাস সেভেনে পড়ি। আব্বা আমাকে কুমারখালী এমএন হাই স্কুলের পন্ডিত মশাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়তে পাঠিয়ে দিলেন। পন্ডিত মশাইয়ের পুরো নাম শ্রী কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। ব্রিটিশ আমলে গোল্ড মেডালিস্ট কাব্য তীর্থ; মেট্রিকুলেট।
আমাদের এলাকায় কিংবদন্তি শিক্ষক হিসেবে এখনো তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি বলতেন, একটা বাংলার অনুচ্ছেদ ইংরেজিতে কিভাবে অনুবাদ করে দেয় কেউ তার ওপর নির্ভর করে সে কি রকম ইংরেজি জানে। কথাটা আমার আজও মনে আছে। ইংরেজি সাহিত্য যে তিনি খুব বেশি পড়াশোনা করেছিলেন তা নয়। তবে বুনিয়াদ বা ভিত্তি ছিল খুবই সবল।ইংরেজি ও বাংলার ব্যাকরন বিষয়ে তিনি ছিলেন পারদর্শী। লিখতে পারতেন অসাধারণ ভাবে।
যে বিষয়ে লিখতে বসেছি। তখন সকালের ব্যাচে আমি ছিলাম ক্লাস সেভেনের এবং একমাত্র ছেলে। বাকি তিন চার জন মেয়ে ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। ওরা নিচের পাটিতে বসতেন। আমি একা একা উপরের চকিতে বসতাম। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েগুলো ছিলেন আমার বেশ সিনিয়র ; ওদের হাতে থাকতো টেস্ট পেপার্স। আমি জানি না এখন টেস্ট পেপারস আছে কিনা। আগে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের হাতে এই বইটি থাকতো। সম্ভবত আদিল ব্রাদার্সের প্রকাশিত।
সিনিয়র সেই সব আপুদের কথা ভুলে গিয়েছি প্রায়।দুজনের কথা মনে আছে। একজন ছিলেন এলঙ্গি এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বীরেন বাবুর মেয়ে। অপরজনের সঙ্গে পরবর্তীকালে ডাক্তার আফতাব উদ্দিন এর কম্পাউন্ডার বাকি ভাইয়ের বিবাহ হয়। আরেক পরিচয় হিরনের বোন।
তবে কারোরই নাম মনে নেই। অন্যদের বাড়ী পাড়ার কোন এলাকায় কিছুই মনে নাই। আমি ক্লাস সেভেনে আর ওনারা এসএসসি পরীক্ষার্থী, দূরত্ব তো কিছুটা ছিলই। পন্ডিতমশাই টেস্ট পেপার দেখে উনাদেরকে বিভিন্ন টাস্ক দিতেন। উনারা সেগুলো করে দিলে যেখানে যেখানে ভুল হতো আমাকে আবার তিনি জিজ্ঞেস করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে আমি শুদ্ধ করে বলে দিতে পারতাম। এভাবে ওই আপুদের কাছে আমি এক ধরনের স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়ে যাই।
সে সময় আমি ১১-১২ বছরের বালক মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ১৪ বছরের বালকদের নিয়ে লিখেছেন। যা লিখেছেন আমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য ছিল ওই সময়। ওই আপুদের আমি মনে করতাম কত উপরের ক্লাসের ছাত্রী। কত না জ্ঞান বুদ্ধি ওনাদের। সে সময় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বলা হত এসএসসি ক্যান্ডিডেট। ক্যান্ডিডেট শব্দের মধ্যে এক ধরনের চমক থাকতো। সবাই সমীহ করতেন। তখন আলোচনা শুনতাম এসএসসি পরীক্ষায় ডিভিশন থাকতে হবে। প্রথম দিকে ডিভিশন কি আমি বুঝতাম না। পরে বুঝলাম ডিভিশন মানে সেকেন্ড ডিভিশন। আগের দিনে ফার্স্ট ডিভিশন খুবই কঠিন ছিল। সাধারণত তাই সেকেন্ড ডিভিশন টাই আলোচনায় আসতো।
এই পোস্টে যে আপুদের কথা লিখছি তাদের কেউই এই পোস্টটি পড়বেন না।সেটার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভেবে পাচ্ছি না তবুও কেন আমি লিখছি। বীরেন বাবু খুবই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। ধুতি পরে ছাতা হাতে হেঁটে হেঁটে বাজারের দিকে আসতেন। চলাফেরা ও কথাবার্তাতেও বনেদিপনা ছিল। এলংগী এলাকায় পুকুরঘাটসহ তার বাড়ি ছিল। সম্ভবত তার সন্তানরা সবাই ছিলে মেয়ে। এখন সবাই ওপার বাংলায়।
আবুল হাসানের কবিতা পাখি হয়ে যায় এই প্রাণ তাতে একটি লাইন আছে ; সরজু দিদিরা ওই বাংলায়। প্রসঙ্গত এই লাইনটার কথা মনে পড়লো।
পন্ডিতমশাইয়ের কাছে পড়ার সময় ওই আপুদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে খুবই কম।হলেও কি কথা হয়েছে এখন আর আমার মনে নেই। উনারা আমাকে খুবই ছেলেমানুষ মনে করলেও ভেতরে ভেতরে আমি হয়তো অনেক কিছুই বুঝতাম।
পন্ডিতমশাই সকালে আমাদের পাঠ চুকিয়ে বাজারে যেয়ে এক চক্কর দিয়ে আসতেন। তিনি বসতেন দেবুর বাবার ডিসপেন্সারিতে। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন উনার নামটা ভুলে গেছি। দেবুর অন্য ভাইদের নাম ছিল অভিজিৎ, বিশ্বজিৎ, বিপ্রজিত ইত্যাদি। সেখানে পন্ডিতমশাই এক কাপ চা খেয়ে বাসায় ফিরে প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলের দিকে চলতেন। আগের দিনে ওনাদের ছিল গত বাধা জীবন। শীতকালে গায়ে একটা চাদর ঝুলিয়ে রাখতেন কিন্তু কখনো পুরোপুরি গায়ে দিতেন না। কাঁধে ঝোলানো থাকতো।
সন্ধ্যার পর আবার প্রাইভেট পড়াতে বসতেন।৭ - ৮ টা হারিকেন জমা হয়ে যেত। কখনো কখনো আমি সন্ধ্যার পরেও গিয়েছি। ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি একাদিক্রমে পন্ডিতমশাইয়ের সান্নিধ্যে ছিলাম। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকগণ কেউ অংক কিংবা ইংরেজিতে কিছু ভুল করলে তিনি মৃদু সমালোচনা করতেন। এই সমালোচনা থেকে কেউই বাদ পড়তেন না। আমরা এটা উপভোগ করতাম।
একদিন আমি বিকেলের দিকে স্কুলে গিয়েছিলাম। দেখি হেডমাস্টার সৈয়দ গোলাম মোস্তফা স্যার ও পন্ডিত মশাই দুজনে ইংরেজিতে কথা বলছেন। পন্ডিতমশাই নেস ফিল্ডের গ্রামারের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি ইতিহাসের প্রতিও দুর্বল ছিলেন। মীরজাফরের পুত্র মিরন যখন বজ্রপাতে নিহত হয় তখন তার পকেটে একটি নোট বই পাওয়া গিয়েছিল যাতে অনেকের নাম লেখা ছিল। মিরনের হিট লিস্টে এইসব ব্যক্তিদের নাম লেখা ছিল। পন্ডিতমশাই একদিন এই গল্প করেছিলেন আমাদের কাছে।
আরেকবার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন বিশেষজ্ঞের লেখায় তিনি নাকি সেটা পড়েছিলেন।এখনকার জিও পলিটিক্সের বিভিন্ন তত্ত্ব শুনে আমার ওনার কথাটা মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
শুরু করেছিলাম আমার সেই সিনিয়র আপুদের কথা দিয়ে। জানিনা তারা এখন কে কোথায় আছেন। যদি ওরা জানতেন সেই ক্লাস সেভেনের আমি ওনাদের নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট লিখছি কতই না মজার হত।
লেখক: সাবেক সচিব।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
১৪১ বার পড়া হয়েছে