বন্ধ হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের লাইফগার্ড সেবা, ঝুঁকিতে লাখো পর্যটক

রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৭:২৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জীবনরক্ষাকারী লাইফগার্ড সেবা।
গত একযুগ ধরে কাজ করে আসা সি-সেইফ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা তহবিল সংকটে ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে ১ অক্টোবর থেকে সৈকতে নামা লাখো পর্যটক পড়বেন সরাসরি ঝুঁকিতে।
প্রতিদিনের পরিচিত দৃশ্য, আর দেখা যাবে না
সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবণী সৈকতের বালুতে লাল-হলুদ জার্সি পরা যুবকদের বাঁশির শব্দ আর হাকডাকে সতর্ক হতেন গোসলে নামা পর্যটকরা। কেউ বেশি দূরে চলে গেলে লাইফগার্ডদের ডাক আসত, কখনো বা ঝুঁকি নিয়ে নামতে হতো সাগরে। এই পরিচিত দৃশ্য এবার থেমে যাচ্ছে। লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হওয়ায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে সৈকতের সবচেয়ে ব্যস্ত এই পাঁচ কিলোমিটার এলাকা। ইতিমধ্যে অব্যবহৃত থাকা বাকি ১১৫ কিলোমিটার সৈকতের মতোই, এই অংশটিও হয়ে উঠবে পুরোপুরি অরক্ষিত।
উদ্ধার হয়েছে শত শত প্রাণ, এখন বন্ধের মুখে উদ্যোগ
২০১২ সাল থেকে ব্রিটিশ দাতা সংস্থা Royal National Lifeboat Institution (RNLI)-এর অর্থায়নে শুরু হয় সি-সেইফ লাইফগার্ড কার্যক্রম। এই সময়ে তারা ৮১৫ জন পর্যটককে সমুদ্রের স্রোত থেকে উদ্ধার করেছে। অথচ একই সময় মারা গেছেন ৬৫ জন, যাদের অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
চলতি বছরেই, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু ঘটেছে সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার ফলে। সম্প্রতি কলেজছাত্র আয়মান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর করুণ পরিণতি আরও একবার লাইফগার্ডদের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনে দেয়।
লাইফগার্ড মোহাম্মদ ওসমান জানান, কেবল গত সপ্তাহেই সাতজন পর্যটককে তারা উদ্ধার করেছেন। অথচ এই জীবনরক্ষাকারী দলটি এখন নিজেদের জীবিকার দুশ্চিন্তায় দিশেহারা। ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মীসহ মোট ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রকল্পের আওতায় কর্মরত ছিলেন, যাদের মাসিক ব্যয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। বছরে প্রয়োজন হতো দেড় কোটি টাকার মতো।
হোটেল কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব, কিন্তু সাড়া নেই
সৈকতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে লাইফগার্ড কার্যক্রম চালু রাখার জন্য হোটেল মালিকদের অর্থায়নে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বড় হোটেলগুলোকে তিনজন এবং ছোট হোটেলগুলোকে একজন করে লাইফগার্ডের ব্যয়ভার নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি জানিয়েছে, তারা এত বড় অংকের তহবিল জোগান দিতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, “সরকারি নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও, হোটেলগুলো একত্রে ১৪-১৫ লাখ টাকা মাসে দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আপাতত সেবা চালু রাখা সম্ভব নয়।”
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা মানুষগুলো আজ অনিশ্চয়তায়
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইফগার্ডরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহু পর্যটকের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির জয়নাল আবেদীন বলেন, “একাই ৯৮ জন পর্যটককে জীবিত উদ্ধার করেছি, ১০টি মরদেহ উদ্ধার করেছি। এখন নিজেই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছি।”
আরেকজন কর্মী আকরাম ত্রিপুরা জানান, “২০ হাজার টাকায় সংসার চালাতাম। চাকরি হারালে কোথায় যাব, বুঝতে পারছি না।”
সমাধানের প্রস্তাব থাকলেও বাস্তবায়ন অনিশ্চিত
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “এই সেবা বন্ধ করা উচিত নয়। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ফান্ড থেকে সাময়িকভাবে ব্যয়ভার নেওয়া যেতেই পারে। শোনা যায়, কমিটির ফান্ডে কোটি টাকার বেশি রয়েছে।”
তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হোটেল মালিকদের সঙ্গেই বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। কিন্তু কোনো পক্ষই এখনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ
লাইফগার্ডরা সরে গেলে সমুদ্রসৈকতে নিরাপত্তা থাকবে না—এটা সকলেই বুঝছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “লাইফগার্ড না থাকলে কতজনের মৃত্যু ঘটত, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।”
ঢাকার পর্যটক আহসান শাওন বলেন, “বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশে নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। গোসলকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জানতাম না, এত গুরুত্বপূর্ণ সেবা বেসরকারি উদ্যোগে চলে।”
সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ সেবাটিকে অবিলম্বে রক্ষা করা না গেলে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প বড় ধাক্কা খেতে পারে। শুধু পর্যটক নয়, জীবন নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া লাইফগার্ডদের ভবিষ্যতও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
১২৪ বার পড়া হয়েছে