শিবির কর্মী থেকে বিএনপি নেতা
কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে বিতর্কের কেন্দ্রে ইঞ্জিনিয়ার জাকির সরকার!

বৃহস্পতিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০১ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
শহীদ জিয়ার আদর্শে লালিত রাজনৈতিক দল বিএনপিতে প্রকট কোন্দল, দখল, চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ, পারিবারিক জীবন ঘিরে তুমুল বিতর্ক একজনকে ঘিরেই! কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার।
আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতোই কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির শীর্ষনেতার দায়িত্ব পেয়ে রাতারাতি লাইমলাইটে চলে আসেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, কুষ্টিয়ায় বিএনপিতে দীর্ঘদিনের ঐক্য ভেঙে শৃঙ্খলাও বিনষ্ট করেছেন জাকির সরকার।
একসময়ের ছাত্রশিবির কর্মী থেকে তিনি আজ কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সদস্য সচিব! দলীয় পদে হঠাৎ উত্থান ঘটলেও শুরু থেকেই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, আর্থিক কেলেঙ্কারি, ক্ষমতার যাচ্ছেতাই অপব্যবহার এবং ব্যক্তিজীবনের বিতর্ক নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তিনি। ফলে জেলা বিএনপির রাজনীতিতে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচনে জেলার ৪টি আসনে ভরাডুবির শঙ্কা জোরালো হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৮৮-৮৯ সালে বুয়েটে পড়াশোনার সময় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের সাথী হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন জাকির হোসেন সরকার। বুয়েট ছাত্রসংসদের তৎকালীন ভিপি লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার তারিক বিন আজিজের কাছে ইঞ্জিনিয়ার জাকির সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি বুয়েটে যখন পড়েছেন তখন আর যাই করুন, ছাত্রদল করেননি। তিনি আল্লাহর নবী রাসুলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা কেউই ইসলাম প্রচারে ইহুদি নাসারা বা কাফেরদের মধ্যে ঢুকে কখনই কোনো কৌশল অবলম্বন করেন নাই। প্রকাশ্যে সবকিছু করেছেন। অথচ এরা বিভিন্নভাবে নানান দলে ঢুকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এদেরকেই বলা হয় মুনাফিক
এবিষয়ে তথ্য জানাতে বুয়েটের তৎকালীন ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী হাসিবুর রশিদ সিপুন বিএনপি থেকে জাকির সরকারের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভবনা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তারা সে সময় ক্যাম্পাসে গুপ্তভাবে শিবির করতো। কারণ তখন শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। বিএনপি সরকারের (২০০১-২০০৬) সময় ব্যাংক ঋণ সুবিধা নিয়ে 'সরকার স্টিল' নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি।
২০১৪ সালে কুষ্টিয়ায় বিএনপির কোনো পদে না থাকলেও তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহম্মেদ রুমীর সহায়তায় কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হন জাকির সরকার। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তি করেন তিনি। চুক্তির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাকে আড়ালে সহযোগিতা দেয়, আর তিনি বিএনপি প্রার্থী পরিচয়ে ভোটে অংশ নিয়ে জয়ী হন। নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সাংসদ মাহবুব-উল হানিফের সহায়তায় দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বীরদর্পে উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কেন্দ্র থেকে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয় জাকির হোসেন সরকারকে। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আর বিতর্ক ওঠে। বালুমহল ও পরিবহন সেক্টরে প্রভাব বিস্তার, দখল ও নিয়মিত চাঁদাবাজি, দলীয় কমিটিতে স্বজনপ্রীতি ও অর্থের বিনিময়ে পদ বণ্টন, আওয়ামী লীগ ও চরমপন্থীদের সঙ্গে আঁতাত, জামায়াত নেতা আমির হামজাকে নিয়ে একাধিক ইসলামিক মাহফিল আয়োজন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব কারণে তৃণমূলে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা ভীষন অবমূল্যায়িত হয়েছেন। ১৬ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিভিন্নভাবে দলীয় পদ বঞ্চিত ও উপেক্ষিত নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এর প্রতিবাদে জোটবেঁধে কুষ্টিয়া জেলাজুড়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে দিনের পর দিন প্রতিবাদী নানান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এমনকি রাজধানীতে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে।
জেলা বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের পলাতক সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলামের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতিতে টিকে আছেন জাকির সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও তিনি আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। এছাড়া কুষ্টিয়ার আলোচিত শীর্ষ চরমপন্থী নেতা জাহাঙ্গীর কবির ওরফে লিপটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও বহু আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি সেনা অভিযানে কুষ্টিয়ায় লিপটন গ্রেফতার হলেও মামলার এজাহারে প্রভাব খাটিয়ে তাকে রক্ষা করার অভিযোগও রয়েছে জাকির সরকারের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আতাত, দলীয় কমিটি গঠন নিয়ে পদ বাণিজ্য এবং জামায়াতে ইসলামীর এক সময়ের সক্রিয় সদস্য হিসেবে তকমা লেগে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার বর্তমানে ব্যাপক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। এছাড়া, কুষ্টিয়া সদর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জনপ্রিয় বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনকে দল বিশেষভাবে মূল্যায়ন করছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এতে সোহরাব উদ্দিনের এবার বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে।
এর প্রভাবেই জামায়াত নেতা আমির হামজাকে সুযোগ করে দিতে এবং যে কোনো আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নের জন্য অপতৎপরতা শুরু করেছেন ইঞ্জিনিয়ার জাকির সরকার। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য, গ্রুপিং ও গুজব ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। পেইড এজেন্ট নিযুক্ত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়াচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি, জনপ্রিয় একজন বিএনপি নেতার ব্যবসায়িক ইমেজ ক্ষুণ্ণ করার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। জাকির সরকার কুষ্টিয়া সদর আসনে মনোনয়ন না পেলে তার পরবর্তী টার্গেট কুমারখালী-খোকসা আসন। একারণেই তিনি এই আসনের বিএনপি নেতাদের ইমেজ ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় বিএনপির ওয়াচডক ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা দলটির সংগঠনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এই পরিস্থিতি দলের ভিতরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তার মতো নেতাদের দল থেকে বহিস্কারের দাবিও উঠেছে।
রাজনীতির মতো ব্যক্তিজীবনেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি জাকির সরকারের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশ-বিদেশে তার দুই স্ত্রী রয়েছেন। এক স্ত্রী বাংলাদেশি, অপরজন চীনা নাগরিক। দুই স্ত্রী ও তাদের ছয় সন্তানই ঢাকার একই বহুতল ভবনে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন। দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, তার ব্যক্তিজীবনের এই দ্বৈততা ও নীতিনৈতিকতা নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় মহলেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে জানা গেছে, তার বাংলাদেশী স্ত্রী ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সক্রিয় নেত্রী এবং তার বাবাও একজন জামায়াত নেতা।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. শামীম উল হাসান অপু বলেন, জাকির সরকারের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠন হিসেবে দল ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, তাকে এখনই বহিষ্কার বা অব্যাহতি না দিলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়ার ৪টি আসনেই বিএনপি ভরাডুবির মুখে পড়বে।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজল মাজমাদার বলেন, আমরা যারা ত্যাগী কর্মী, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি, আজ তাদের কোনো মূল্যই নেই। হাইব্রিড নেতারা দখল করেছে দলের নেতৃত্ব। জাকির সরকারের মতো চরম বিতর্কিত নেতার কারণে কুষ্টিয়ায় বিএনপি দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
এদিকে, বক্তব্য নেওয়ার জন্য কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকারের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
৩৪৩ বার পড়া হয়েছে