সর্বশেষ

ফেবু লিখন

ওড়ে গেছে খাঁচার ভেতর অচিন পাখি

ড. মুনিরুছ সালেহীন
ড. মুনিরুছ সালেহীন

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:০৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
গানটা শুনেছিলাম সেই কবে! বয়সে তখনো টিন।কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একজন সহপাঠী গেয়েছিল গানটা- গফরগাঁও কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, টিনের বড় মিলনায়তনে।

"তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম।" আমাদের হাতে তখনো যেন লেগে আছে কুড়ানো আমার কষ, লুঙ্গিতে জামের দাগ বিশ্রিভাবে প্রকট হয়ে আছে। গানটি পরে শুনেছি ফরিদা পারভীনের কন্ঠে গানটি। তাঁর তৎকালীন স্বামী গীতিকার মোহাম্মদ আবু জাফরের লেখা গানটির প্রথম শিল্পী ফরিদা পারভীন। সেই গান, সাথে রেডিওতে শোনা 'এই পদ্মা এই মেঘনা' আর লালনের গান দিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রোতার মনে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন তিনি । 'আনন্দ বেদনায়, মিলন-বিরহ সংকটে' তাঁর গান বার বার মনে করিয়ে দেয়, নস্টালজিয়ায় মুগ্ধ হয়ে মনের ভেতর হুহু করে ওঠে- 'যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়!'

 

মরমী কবি লালল ফকিরের গান যার কন্ঠে জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করে তিনি ফরিদা পারভীন। আমার সরকারি চাকুরি জীবনের প্রথম কর্মস্থল কুষ্টিয়ার মেয়ে তিনি। আমি থাকতাম তাঁর বাসার কাছেই। কতদিন ভেবেছি কোনো এক বন্ধুকে নিয়ে একটু দেখা করে আসি আমার প্রিয় এই শিল্পীর সাথে। কেন যেন তা আর হয়ে ওঠেনি কুষ্টিয়ায় আমার স্বলকালীন অবস্থানের সময়। সেই আফসোস পরে দূর হয়েছিল অন্যভাবে।

 

১৯৯৪। আমাদের শাঁখচূড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তী - তিরিশ বছর পূর্তি। আমাকে করা হয়েছে উদযাপন কমিটির আহবায়ক। সবার প্রত্যাশা স্কুলের রজতজয়ন্তীতে একটা জম্পেশ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে। তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল ফরিদা পারভীনের কথা। আমার সিনিয়র এক কলিগের (মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন স্যার৷ Mohammed Shahabuddin ) সাথে কথা বলতেই জানা গেল ফরিদা পারভীন তাঁর বেশ পরিচিত। একই অঞ্চলের মানুষ- স্যার চুয়াডাঙার, ফরিদা পারভীন কুষ্টিয়ার। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে স্যারের ওঠাবসার সুবাদে তাদের পরিচয়। আমাদের গ্রামের স্কুলের প্রোগ্রামে এই শিল্পীকে কীভাবে পাওয়া যায় জিজ্ঞেস করতেই স্যার বললেন, "কোনো চিন্তা নেই। আমি ব্যবস্থা করে দেব।" আমাদের বাজেট তো খুব সীমিত। উনাকে কেমন সম্মানী দিতে হবে জানতে চাইলে স্যার বলেন, "ওটা নিয়ে ভাবতে হবে না। শিল্পীর যাওয়া আসার ব্যবস্থা করো আর তোমরা যা পারো দিয়ো। আমি ওকে বলে রাখবো।"

 

শিল্পীর সম্মানী নিয়ে ততদিনে আমরা তিক্ত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। নিজেদের সাধ ও সাধ্যের ব্যবধান ভুলে গিয়েছি দেশের খ্যাতিমান এক স্টার শিল্পীর কাছে। তাঁর গান গ্রামের দর্শকশ্রোতারা খুব পছন্দ করবেন বলে আমাদের মনে হয়েছে। সেখানেও গিয়েছি শিল্পীর কোনো বন্ধুর রেফারেন্সে। তিনি তাঁর ড্রয়িংরুমে আমাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। হাসিমুখে কথা বলেছেন। তারপর সম্মানীর প্রসঙ্গে জানালেন ঢাকার বাইরে তিনি এত টাকা নেন। সম্মানীর ফিগার শুনে আমাদের আক্কেলগুড়ুম। আমি উনার গানের বিষয়, সাধারণের জন্য উনার ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট ইত্যাদি এবং গ্রামের একটা স্কুলের প্রোগ্রামের বাজেট স্বল্পতার কথা বলে সম্মানীর অংকটা কমানোর সুযোগ আছে কী না তা সবিনয়ে তা জানতে চাই। সেই শিল্পীর চাছাছোলা জবাব, "ভাই, ওইসব ভাবের কথা না বলাই ভালো। আমার রেট ফিক্সড।" শুধুমাত্র বাজেট স্বল্পতার জন্য ওই শিল্পীকে আমাদের অনুষ্ঠানে নিতে পারবো না- এটা নিয়ে যতটা না কষ্ট পেয়েছি তারচে' বেশি আঘাত সেদিন পেয়েছিলাম সম্মানী প্রসঙ্গে তাঁর বলার ধরণে।

 

যাক,সেই অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত শিল্পী হিসেবে পেয়েছিলাম ফরিদা পারভীন ও কিরণচন্দ্র রায়কে। তখনো আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ যায়নি। জেনারেটরের আলোয় দর্শকশ্রোতায় উপচে পড়া স্কুলের খোলা মাঠ মাতালেন এই দুই কিংবদন্তি শিল্পী। দর্শকদের তুমুল করতালি আর 'ওয়ান মোর, ওয়ান মোর' শুনতে শুনতে তাঁরা গেয়েছিলেন তাঁদের জনপ্রিয় প্রায় সব গান। গফরগাঁয়ের গ্রামের কোনো স্কুলে ওই ধরণের সাড়াজাগানো প্রোগ্রাম আর কখনো হয়েছে বলে শুনিনি।

 

কিরণচন্দ্র রায়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আয়োজকদের অন্য একজন। ফরিদা পারভীনের যাবতীয় দায়দায়িত্বে আমি। বিদায়ের সময় সসংকোচে উনার হাতে সম্মানীর একটা পাতলা সাদা খাম তুলে দিয়েছিলাম। তিনি আনমনে হাত বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, কত টাকা তা জিজ্ঞেসও করেননি।

 

লালনগীতির কিংবদন্তি ফরিদা পারভীন চলে গেছেন। নিজের গানে হারিয়ে যাওয়া দিন আর ফিরে না আসার আক্ষেপ করলেও আমরা জানি তাঁর গানে বার বার ফিরে আসবে আমাদের হারানো দিন, বার বার ফিরে আসবেন তিনি, আমাদের হৃদয়ে।

 

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, কবি ও প্রাবন্ধিক।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)

১৩০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
ফেবু লিখন নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন