বিকৃত যৌন বাণিজ্যের মূল হোতার দুবাইয়ে সন্ধান, ভয়াবহ নির্যাতনের শেষে হত্যা

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:০০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিলাসবহুল শহর দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় গড়ে উঠেছে ভয়াবহ যৌন বাণিজ্যের চক্র। অসহায় আফ্রিকান তরুণীদের ফাঁদে ফেলে যৌন ব্যবসায় নিযুক্ত করে একদল চক্র।
সম্প্রতি বিবিসি'র একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে।
এই চক্রের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন চার্লস মোসিগা, যিনি লন্ডনের এক সাবেক বাসচালক বলে পরিচয় দেন। প্রকাশ্যে নিজেকে ইভেন্ট সংযোগকারী হিসেবে তুলে ধরলেও গোপনে তিনি গড়ে তুলেছেন এক সুসংগঠিত যৌন বাণিজ্য নেটওয়ার্ক। ছদ্মবেশী প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি স্বীকার করেন, তিনি প্রতি রাতে এক হাজার ডলারে নারী সরবরাহ করতে পারেন এবং ‘তাদের দিয়ে প্রায় সবকিছু করানো যায়’।
‘সুপারমার্কেটে চাকরি’ প্রত্যাশায় এসে বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার
বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে আসে, উগান্ডাসহ বিভিন্ন আফ্রিকান দেশ থেকে তরুণীদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই আনা হয়। অনেকে ভেবেছিলেন, তাঁরা হোটেল বা সুপারমার্কেটে কাজ করবেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, তাঁদের জড়ানো হয় যৌন পেশায়।
‘মিয়া’ নামের এক তরুণী বলেন, তাঁকে বলা হয়— ভিসা, বাসা ভাড়া, খাবার খরচ ও বিমানের টিকিট বাবদ প্রায় ২৭০০ ডলার ঋণ হয়েছে, যা শোধ না করলে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাঁকে পুরুষদের ‘অনুনয় করে কাছে আনতে’ বলা হয়, যাতে তারা শয্যাসঙ্গী হতে চায়।
চরম বিকৃত যৌনচাহিদার শিকার নারীেরা
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেক ইউরোপীয় ধনাঢ্য গ্রাহক বিকৃত ও অবমাননাকর যৌন চাহিদা পোষণ করেন। এক নারী বলেন, এক নিয়মিত গ্রাহক মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করে তা খাওয়াতে চাইতেন। আরেকজন জানান, কেউ কেউ এমন নারী খুঁজত যারা কাঁদবে, পালাতে চাইবে—এতে তাদের আরও উত্তেজনা হতো।
‘লেক্সি’ নামের এক তরুণী বলেন, তাঁর বিশ্বাস, এসব বিকৃততার পেছনে জাতিবিদ্বেষের উপাদানও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা এমন কাউকে খুঁজত, যে হবে কৃষ্ণাঙ্গ এবং দুর্বল।’
মৃত্যুর ঘটনারও সন্ধান মিলেছে
বিবিসি আরও জানতে পারে, মোসিগার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই নারী রহস্যজনকভাবে দুবাইয়ের উঁচু ভবন থেকে পড়ে মারা যান। একজন ছিলেন মোনিক কারুঙ্গি, যিনি উগান্ডার পশ্চিমাঞ্চল থেকে এসেছিলেন। প্রাথমিকভাবে বলা হয়, এটি আত্মহত্যা। তবে পরিবার ও বন্ধুরা এটিকে সন্দেহজনক মৃত্যু বলে মনে করেন।
মোনিকের ঘনিষ্ঠজন ‘মিয়া’ বলেন, মোনিক চক্র থেকে বেরিয়ে একটি চাকরি পেয়েছিলেন এবং ফ্ল্যাট বদল করেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক কয়েক দিন আগেও তিনি ছিলেন খুব আশাবাদী। কিন্তু ২০২২ সালের ১ মে হঠাৎই তাঁর মৃত্যু হয়। মোনিকের দেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। বিবিসির অনুসন্ধানে জানা যায়, তাঁকে আল কুসাইস কবরস্থানে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে দাফন করা হয়।
মোনিকের এক আত্মীয় বলেন, পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর ফ্ল্যাটে মাদক ও অ্যালকোহল পাওয়া গেছে এবং শুধুমাত্র তাঁর আঙুলের ছাপই ছিল বারান্দায়। তবে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
মোসিগা: একজন ছায়ার মানুষ
চার্লস মোসিগার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। তিনি বিভিন্ন নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন এবং কখনোই নিজের নাম ব্যবহার করে ব্যবসা করেন না। গাড়ি, ফ্ল্যাট ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হয় তাঁর সহযোগীদের নাম।
চক্রের সাবেক সদস্য ‘ট্রয়’ দাবি করেন, তিনি ছিলেন মোসিগার অপারেশন ম্যানেজার। তাঁর ভাষ্য মতে, মোসিগা বিভিন্ন নাইটক্লাবের নিরাপত্তাকর্মীদের ঘুষ দেন, যাতে তাঁর মেয়েরা ক্লাবে ঢুকে সহজে গ্রাহক খুঁজে পেতে পারে। ট্রয় বলেন, ‘মোসিগা এমনভাবে সব গুছিয়ে নিয়েছেন, যেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না থাকে।’
পুলিশ নিষ্ক্রিয়, চক্র চলছেই
লেক্সি বলেন, একবার তিনি পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলে তাঁরা বলেন, ‘তোমরা আফ্রিকানরা একে অপরের সমস্যা।’ এরপর তাঁরা ফোন কেটে দেয়।
বিবিসি দুবাই পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
আফ্রিকায় ফিরে যাওয়া নারী এখন কাজ করছেন উদ্ধারে
সৌভাগ্যবশত, লেক্সি পরে উগান্ডায় ফিরে যান এবং এখন তিনি এই চক্রে জড়ানো নারীদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কাজ করছেন।
চার্লস মোসিগার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠে এসেছে, তার একটিও তিনি স্বীকার করেননি। বিবিসির সঙ্গে আলাপে তিনি সব অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে দাবি করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে আসা নারীশ্রমিকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, নিখোঁজ হওয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা, পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো বিকৃত বিলাসী জীবনের বাস্তবতা—সব মিলিয়ে দুবাইয়ের আড়ালে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
১২৬ বার পড়া হয়েছে