সর্বশেষ

মতামত

দেশের চিকিৎসায় সুস্থ জামায়াত আমীর: দায়িত্বে ব্যর্থ, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসায় উপদেষ্টা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৩:১৮ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
নির্ভরযোগ্যতা কিংবা দেশপ্রেম—নাকি রাজনীতি ও সুবিধাবাদ? দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা, শীর্ষ কর্মকর্তার বিদেশ যাত্রা, পক্ষান্তরে কোনো নেতার দৃঢ় দেশপ্রেম কিংবা অন্যজনের জনদৃষ্টিভঙ্গি—এই প্রশ্নসমূহ ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আজ বিতর্ক উত্তাল।

দেশের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার অযোগ্যতা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও ব্যক্তিগত স্বার্থে বিদেশে চিকিৎসার দৃষ্টান্ত, ও বিপরীতে দেশের চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ আস্থায় রাখা তিন রাজনৈতিক-আন্তর্জাতিক নেতা—এই বিষয়গুলোকে তুলনা ও বিশ্লেষণে তদন্ত করে আমার আজকের এই প্রতিবেদন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিদেশযাত্রা ও অযোগ্যতার বিতর্ক
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ক্যান্সারের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি সিঙ্গাপুর গেছেন। সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সমাবেশ এবং নাগরিক সমাজে এখন প্রশ্ন, তিনি যখন দেশের স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে, তখন জীবনের সংকটে নিজ দেশের চিকিৎসার প্রতি অনাস্থা ঘোষণা করে বিদেশে চিকিৎসা নেন কীভাবে?


এক বছর আগে দায়িত্ব পেলেও কোনো মৌলিক সংস্কার, জনভিত্তিক উদ্যোগ কিংবা সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে তার বিশেষ কর্মক্ষমতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাদ্দ বাড়ানো, মাত্রাতিরিক্ত সভা ও নীতিপত্র ছাড়া সাধারণ মানুষের চিকিৎসা, সেবা প্রবাহে কোনো দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। বরং দুর্নীতি, সিন্ডিকেট আর দালালি বেড়েছে—এই অভিযোগ আরও দৃশ্যমান।

দেশের ব্যবস্থা ও রাজনীতিকের নিজস্ব আস্থা
দেশে উল্লেখযোগ্য আধুনিক বেসরকারি হাসপাতাল এবং দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও যখন একজন শীর্ষ নীতিনির্ধারক বিদেশে চিকিৎসা নেন, তখন দেশের স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা ও জনগণের আস্থার পতন হয়। অথচ দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ পাওয়া যায় দেশীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে—জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজের হার্টে পাঁচটি ব্লক নিয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে সফল বাইপাস সার্জারি করান, যদিও তিনি সহজেই বিদেশে যেতে পারতেন। এ সিদ্ধান্ত মেডিকেল সোসাইটি এবং সাধারণ জনগণের কাছে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার একটি অনন্য বার্তা হিসেবেই প্রতিয়মান হয়।


মিথ্যাচার ও সুবিধাবাদ: দেবী শেঠির নামের অপব্যবহার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হার্টের সমস্যায় (ত্রি-নালী ব্লক) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে বাইপাস সার্জারি নিয়েছিলেন। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মহল ও দলীয় বয়ান ছিল—ভারতীয় হার্ট বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির সুপারিশে তাকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, উপমহাদেশের সবচেয়ে নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠি চাইলে সরাসরি চিকিৎসা দিতে পারতেন অথবা ভারতে বিশ্বমানের কেয়ার দিতেন। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক সুবিধা ও বাহাদুরি রাখতেই দেবী শেঠির নাম ব্যবহার করা হয়েছে—এ প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে সর্বমহলেও।


দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত: ড. মাহাথির
সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি নিজেও চিকিৎসক ছিলেন এবং হার্ট সার্জারির মতো জটিল অবস্থা সত্ত্বেও বিদেশী সুযোগ ফিরিয়ে নিজ দেশেই সফল চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত শুধু প্রতীকী ছিল না—এসব ছিল কৌশলগত দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব এবং দেশীয় চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাস নির্মাণের ঐতিহাসিক চোখে দেখা উদাহরণ। মাহাথির বলেছিলেন—‘‘আমি বিদেশে চিকিৎসা নিতে গেলে, আমার দেশের হাসপাতাল ও ডাক্তারদের উন্নয়ন হবে না—তাই আমি দেশেই থাকব।’’ এটা একটি দেশপ্রেমের উদাহরণ।


গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ব‍্যর্থতা
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আহত হাজারো ছাত্র-জনতা ও তরুণের চিকিৎসা-শুশ্রূষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গৃহীত কার্যক্রম ছিল চরমভাবে অপর্যাপ্ত ও সমালোচিত। ওই সময় ঢাকাসহ দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহত আন্দোলনকারীদের জন্য চিকিৎসার কোনো জরুরি কেন্দ্র স্থাপন, বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন বা ওষুধ ও অপারেশনের পৃথক বরাদ্দের দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি।

বহু আহত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তাহীনতার মুখে চিকিৎসাবঞ্চিত হন—অনেক ক্ষেত্রে স্বজন-সহযোগিতাই ছিল ভরসা। অথচ, দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সর্বাত্মক চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব স্বাস্থ‍্য উপদেষ্টারই ছিল। তার উদাসীনতা, উদ্যোগহীনতা ও রাজনীতিক চাপ এড়ানোর মনোভাব গণআন্দোলনের আহতদের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ববোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, যা আজও সমালোচনার মুখে রয়েছে।


যা করা উচিত
উন্নত চিকিৎসা অবকাঠামো, দক্ষ চিকিৎসক এবং প্রযুক্তির উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও দেশের স্বাস্থ্যখাতে আজ যে অনাস্থা ও সংকট প্রকট, তার মূল উৎস নেতৃত্বের অসহযোগিতা এবং কার্যকর নৈতিকতার অভাবেই নিহিত। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিজ দায়িত্বে ব্যর্থতা স্বীকার না করে পদ আঁকড়ে থাকার ফলে জনমনে আস্থা হারাচ্ছেন—এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যক্তি বিশেষের সুবিধা, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে আন্তরিকতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পক্ষান্তরে, ডা. শফিক কিংবা মাহাথির মোহাম্মদের মতো নেতৃত্ব নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশীয় চিকিৎসার প্রতি আস্থা রেখে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যেটি জাতিকে সম্মান দিয়েছে এবং আত্মবিশ্বাস ফিরিয়েছে।

বর্তমান সময়ের জন্য সবচেয়ে জরুরি, স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা ও নেতৃত্বের প্রতি যে আস্থা নষ্ট হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে সাহসিক ও স্বার্থহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিজ উদ্যোগে পদত্যাগ করা যতটা নৈতিক কর্তব্য, ততটাই আগামীতে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ—কারণ দায়িত্বে থেকে ব্যর্থতার দায় এড়ানো মানেই পরিস্থিতিকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেওয়া। সময় এসেছে, নেতৃত্বে আসা মানে শুধু সুবিধা পাওয়া নয়—বরং দেশের ও মানুষের প্রতি সৎ এবং স্বচ্ছ থেকে দায়িত্বের ঋণ শোধ করা।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৪৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন