আত্মহত্যায় বছরে দেশে প্রাণ হারাচ্ছে ২০ হাজারের বেশি, ঝুঁকিতে কিশোরীরা

সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৪:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার ৫০৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এর মধ্যে কিশোরীদের হার সবচেয়ে বেশি—মাত্র ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৩৫.৪ শতাংশ।
গ্রামের তুলনায় শহরে এই হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, সামগ্রিকভাবে আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) পরিচালিত এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। ২০২২-২৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক লাখ ৮৩ হাজার মানুষের উপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল গত বছর প্রকাশ করে সংস্থাটি। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার ছিল ১৪.৭ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক জরিপে কমে ১২.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে সংখ্যার দিক থেকে আত্মহত্যা এখনও উদ্বেগজনক হারে রয়ে গেছে।
প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দেশে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল—"আত্মহত্যা সম্পর্কে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করে সহানুভূতিশীল ও সহায়ক আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলা"।
গ্রামে আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ
জরিপ অনুযায়ী, শহরে আত্মহত্যার হার ৭.৯২ শতাংশ হলেও গ্রামে তা ১৪.৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বেকার ও কম আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে গলায় ফাঁস (৫০.৯%), এরপর রয়েছে বিষপান (৪১.৮%)।
কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর বয়সে নানা মানসিক চাপ, পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশার চাপ, শিক্ষা ও সম্পর্কজনিত সমস্যার কারণে হতাশা তৈরি হয়। যথাসময়ে চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং না পেলে তা থেকে জন্ম নিতে পারে বিষণ্নতা, যা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, “কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরিবার বা সমাজে সচেতনতা খুবই কম। স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা ও শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া এখন জরুরি।”
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব জানান, “বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে তরুণদের ব্যর্থতা মোকাবিলার দক্ষতা গড়ে তোলার দিকেও নজর দেওয়া দরকার।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আত্মহত্যা প্রতিরোধে চারটি প্রধান সুপারিশ করেছে:
আত্মহত্যার উপায় যেমন বিষ ও অস্ত্রের সহজপ্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করা,
গণমাধ্যমে আত্মহত্যা নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রকাশ,
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আবেগীয় ও সামাজিক দক্ষতা উন্নয়ন,
আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে সহায়তার ব্যবস্থা।
WHO’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ডা. ক্যাথরিন বোহেম এক বিবৃতিতে বলেন, “আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। একে রোধে নীরবতা ও লজ্জার সংস্কৃতি ভেঙে বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।”
সমাধান কী?
সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, “আত্মহত্যার প্রবণতা কিছুটা কমেছে বটে, তবে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া মানুষের সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক। বিষয়টি মোকাবেলায় সরকার, সমাজ ও পরিবার—তিন পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আত্মহত্যা রোধে এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্রিয় ভূমিকা।
১১৯ বার পড়া হয়েছে