সর্বশেষ

আন্তর্জাতিক

পার্লামেন্টে আগুন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে স্তব্ধ নেপাল: বিমানবন্দর বন্ধ, আটকা বাংলাদেশ টিম

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১০:১৩ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয়ঘেঁষা দেশ নেপাল আজ চরম রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটে বিচলিত। গত দু’সপ্তাহে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, এবং তরুণদের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে উত্তাল হয়ে উঠেছে কাঠমান্ডুসহ দেশের প্রধান শহরগুলো।

সরকারের কঠোর পদক্ষেপ—বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তাবাহিনীর তাণ্ডব—প্রতিবাদকে আরো জোরালো করেছে। এই অস্থিরতার মধ্যে দেশের পার্লামেন্ট ভবনে অগ্নিকাণ্ড, প্রাণঘাতী সহিংসতা, এবং অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ নেপালের বর্তমান সংঙ্কটের গভীরতা উন্মোচন করেছে। পক্ষান্তরে, বিমানবন্দরসহ সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় সাধারণ জনগণ, বিদেশি নাগরিক এবং এখানে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে রয়েছে। নয়া নেতৃত্ব, শান্তিপূর্ণ সমাধান, এবং প্রতি স্তরে স্থিতি ফেরানো এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


গণআন্দোলন ও সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা
৪ সেপ্টেম্বর, সরকার দেশে জনপ্রিয় ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে—এমনকি ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ—এগুলো পর্যন্ত। সরকারের কারণ হিসেবে উল্লেখ, নিবন্ধন না করলে তথ্য নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধ দমন অসম্ভব। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ এবং আশাভঙ্গের ফলশ্রুতিতে ‘Gen Z’ আন্দোলন দ্রুতই লাখো মানুষের প্রতিবাদে পরিণত হয়।


দমননীতি ও সহিংসতার বিস্তার
৮ সেপ্টেম্বর, পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সমবেত আন্দোলনকারীরা সরকারি ব্যারিকেড ডিঙিয়ে ভবন প্রাঙ্গণে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান ও গুলি চালায়। এতে করে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় কুড়ির কাছাকাছি, আহত তিন শতাধিক। সরকার দ্রুত কারফিউ ঘোষণা, সেনা মোতায়েন ও নাগরিকদের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।


রাজনৈতিক বিপ্লব: প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
এই সহিংসতার জেরে চরম রাজনৈতিক সংকটে পড়ে দেশ। দীর্ঘদিন দুর্নীতির অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ দলাদলি, এবং প্রশাসন ও নেতৃত্বে জবাবদিহিতার ঘাটতি, এসব মিলিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি আজ ৯ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। নয়া সরকার গঠনের জন্য সংসদে নতুন নির্বাচন ও দলীয় গণনায় চরম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। অচলাবস্থা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা চলছে নেপাল।


যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন: কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ
রাজনৈতিক সহিংসতায় সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সহ সব বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। দেশের ভেতর বাইরে কোনো ফ্লাইট চলাচল করছে না। অফিসিয়াল ঘোষণায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ফ্লাইট ছেড়ে যাবে না। বহু বিদেশী যাত্রী, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশ ফুটবল দলের দুর্ভোগ: সংঘাতের মাঝে আটকা
এই সময় আন্তর্জাতিক ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে নেপালে গিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের আজ ঢাকা ফেরার কথা ছিল।

বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় ফুটবলার, কর্মকর্তা, ক্রীড়া সাংবাদিকরা সবাই Crowne Imperial হোটেলে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আটকা পড়ে রয়েছে। বাইরে যাওয়া, স্থানীয় চলাচল, সবকিছুই এখন বাধাপ্রাপ্ত। দলে কেউ আহত হয়নি, তবে মানসিক চাপ আছে, বাংলাদেশ দূতাবাস ও ফেডারেশন নেপাল সরকারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। বিমান চালু হলে দ্রুত দেশে ফেরার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
এই বিশৃঙ্খলার কারনে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচ বাতিল হয়ে গেছে।


অচলাবস্থার গভীর বিশ্লেষণ: নেপাল রাষ্ট্র ও সমাজের সংকট
নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংকট, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, পারস্পরিক দলাদলি, এবং তরুণদের ব্যাপক বেকারত্ব। এসব নেপালের সামাজিক কাঠামোয় গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। নেতৃত্বের পরিবর্তন, সরকারপন্থী দূরদর্শিতার ঘাটতি, রাজনৈতিক দলগুলোর ঘন ঘন জোট ও পালাবদল, এসব কারণে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা দিনে দিনে কমে গেছে। অর্থনীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সবখানেই অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করছে। রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি করছে।


ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও প্রেক্ষিত
নেপালের বর্তমান অবস্থা একটি পরিণত রাষ্ট্রের সংকটে উদ্ভূত জটিলতা, যেখানে নেতৃত্ব নেই, যোগাযোগ নেই, নিরাপত্তা নেই। পরবর্তী সরকার গঠন, সামরিক ও প্রশাসনিক স্থিতি, নতুন আইনি পদক্ষেপ—সবকিছুই আন্দোলনের গতি, জনগণের মনোভাব এবং পরাশক্তিগুলোর ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন। দেশীয় পরিকাঠামোর ওপর চাপ প্রবল। নেপাল এখন কঠিনতম ক্রান্তিকালে—উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সামাজিক শান্তি—সবকিছুই ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তের ওপরে নির্ভর করছে।

বন্ধুকের নল, সাইবার সেন্সরশিপ, এবং সংকটময় রাজনৈতিক দরাদরি, সবই মিলে তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ আর চরম দাবি-দাওয়ার প্রতিফলন ঘটছে নেপালের রাজপথে। এখন দেশের সামনে দুটি বিকল্প: হয় তারা পুরনো দমননীতি আঁকড়ে ধরে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ঘটাবে, নয়তো সংলাপ ও সংস্কারের মাধ্যমে সত্যিকারের পরিবর্তনের সূচনা করবে। নেপাল নয় গোটা দক্ষিণ এশিয়া এখান থেকে বরং শিখছে—গণতন্ত্র, সহনশীলতা আর তরুণদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে যে কোনো সময় বাড়তে পারে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে, নয়া নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সংস্কার, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা—এসবের ওপরই নির্ভর করছে নেপালের ভবিষ্যৎ।

১৪০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন