সর্বশেষ

ফেবু লিখন

স্মৃতিচারণ

দেখি ফিরে, বার বার- ২

ড. মুনিরুছ সালেহীন
ড. মুনিরুছ সালেহীন

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:৫৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
দিগন্ত রাঙিয়ে প্রতিদিন উদ্ভাসিত হয় একই সূর্য। কিন্তু প্রতিটি সকাল এক রকম হয় না।
সবে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। ভোরে ওঠে সোবহান ক্বারি হুজুরের মক্তব থেকে ফিরে নাকে মুখে কিছু দিয়ে মত্ত হই বিবিধ খেলায়।

মার্বেল কিংবা সিগারেটের খালি প্যাক দিয়ে চারা খেলা। তারপর আছে পুকুরে ঝাপাঝাপি। স্কুলের সময় এগিয়ে এলেও গা ওঠে না বিবিধ ব্যস্ততা থেকে। প্রতিদিনই স্কুলে হাজির হই একেবারে শেষ মুহূর্তে। মাথার চুল তখনো ভাল করে শুকায় না। সেদিন যখন বইখাতা নিয়ে স্কুলের পথে পা বাড়াবো তখন শুনি জমজ বোন দিপু আগেই চলে গেছে—নতুন এক স্কুলে। বাড়ি থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে সে স্কুল। সাথে গেছে পাড়ার আরেক সহপাঠী রানুও। বাজারের প্রাইমারিতে ভালো পড়ালেখা হয় না, তাই অপেক্ষাকৃত ভালো কালুর স্কুলে যাওয়া। আদেশ আমাকেও যেতে হবে ওখানেই।

 

দিঘীরপাড় প্রাইমারি স্কুলের ডাকনাম কালুর স্কুল। কালু বেপারির জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই ওই নাম। অনিচ্ছা, ভয়কে সঙ্গী করে একাকী পথ হাঁটি সেই স্কুলের দিকে। স্কুল প্রাঙ্গনে ঢুকেই বুঝি সব ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। একটা ক্লাসরুমের সামনে পা পড়তেই বুঝি জমজমাট স্কুল। প্রতিটি ক্লাসরুমই ভরা। দুরুদুরু বুকে হাজির হয়েছি ক্লাস ফাইভের দরোজায়। বাইরে থেকেই দেখছি ফর্সা, শুভ্রকেশ এক স্যার চেয়ারে বসে কিছু পড়াচ্ছেন, সামনে ৩০/৩৫ জন শিক্ষার্থী। মেয়েদের বেঞ্চে ৪/৫ জন মেয়ের সাথে দিপুকে দেখে ভরসা পেলাম। কী মনে করে দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে বললাম, " মে আই কাম ইন স্যার?" কীভাবে কোথায় শেখা এই কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে এসেছিল! স্যার আমার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকান। গ্রামের স্কুলের ফাইভ পড়ুয়া কোন ছেলে কবে এভাবে ইংরেজিতে পারমিশন চেয়ে ক্লাসে ঢুকেছে! সব ছেলেমেয়ের চোখ নিজেদের বইখাতা থেকে সরে তখন আমার দিকে। স্যার হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলে নাম ধাম জিজ্ঞেস করেন। তারপর দেখিয়ে দেন পেছনের বেঞ্চে বসতে। তখন চলছিল অংকের ক্লাস। মন- সের- ছটাক, মাস- দিন-ঘন্টার যোগবিয়োগের অংক। এসব অংক আমি ভালই পারি। স্যার সবাইকে বলেন এত নম্বর অংক করে তাকে দেখাতে। আমিও লেগে যাই অংক করতে। এতো ছাত্রের মধ্যে আমার অংকের পারদর্শিতা দেখাবো এই উত্তেজনা আমার মধ্যে। সবার আগে অংক শেষ করে খাতা নিয়ে স্যারের সামনে যাই। স্যার দেখেন অংকের শেষ ধাপে এসে ভুল করেছি সহজ যোগ বা বিয়োগে। কয়েক বার এরকম হওয়ায় টিচার সস্নেহে বলেন, "এতো তাড়াহুড়ো করার কী আছে? ট্রেন ধরার তাড়া আছে?" আমার অস্থিরতার, চঞ্চলতার পরিচয় প্রথম দিনই পেয়ে যান কালুর স্কুলের প্রথম স্যার ও সহপাঠীরা।

 

সেই স্যার সবার কাছে পরিচিত গাড স্যার বা গার্ড স্যার নামে। ভালো নাম আবদুল মান্নান। স্কুলের শিক্ষকতায় আসার আগে তিনি রেলওয়েতে চাকরি করেন গার্ড বা পরিচালক হিসেবে। সেই থেকে গার্ড স্যার। কি যে আমুদে মানুষ ছিলেন এই স্যার। নিজে কখনো কোনো ছাত্রের গায়ে হাত দেননি। কোনো কোনো দিন ছাত্রদের কেউ পড়া না পারলে হয় দাঁড় করিয়ে রাখতেন। ক্বদাচিৎ পড়া- না পারা কারো কান মলাতেন পড়া- পারা কাউকে দিয়ে। সৌভাগ্য্যক্রমে আমি কখনো কারো হাতে কান মলা খাইনি কিংবা কারো কানে ধরার সুযোগও পাইনি।

 

এখনো চোখে ভাসে একটা ছবি—স্কুল ছুটির পর গার্ড স্যার কিছুটা পথ চলতেন আমাদের সাথে। একটু কুঁজো হয়ে বগলে বা মাথায় ছাতা নিয়ে গার্ড স্যার ফিরছেন আমাদের সাথে। আমরা মুখর নিজেদের কলকাকলী। এক এক দিন স্যারের মজার কিছু কথা শুনে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। কী কথা বলতে যেয়ে তিনি একদিন হঠাৎ সুর করে বলেন, "আন্দেশা, গোল গোল বাতাসা।"

 

সেই স্যার মারা যান আমার কালুর স্কুলের পাট চুকানোর কয়েক বছর পরই। তাঁর চলে যাওয়ার ৭/৮ বছর পর তিনি আমাদের পরমাত্মীয় হয়েছেন। তাঁর বড় ছেলের সাথে বিয়ে হয় জমজ বোন দিপুর।

 

শৈশবে বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগে না। কালুর স্কুলেও প্রথম দিনই পেয়ে গেলাম অনেক নতুন বন্ধু। বন্ধু হয়েই শুনলাম এখানে অনেকেই অনেকের সাথে কথা বলে না। আমি নতুন, তাই কারো সাথে বিরোধ নেই। বরং অনেকেরই আগ্রহ আছে আমাকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর। একটু খাতির হতেই একজন বলছে, ওর সাথে মেশা যাবে, ওর সাথে যাবে না। আরো মজার বিষয় ক্লাসের অনেক ছেলেরই বিভিন্ন টাইটেল আছে। ফার্স্ট বয় 'গাই'। সেকেন্ড বয় 'মাগি', অথচ ওরই ক্লাসের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান আর গাট্টাগোট্টা শরীর। একজনকে সবাই ডাকে 'পানি' বলে, আরেকজন 'ঘোড়া'। আমাদের পাশের বাড়ির যে বন্ধুটিকে পাড়ার সবাই পেটুক বলে ক্ষেপাতো, সেটাও আমার সৌজন্যে ফাঁস হলো।

 

হেড স্যার - মোতালেব স্যার-কে স্কুলের ছেলেমেয়েরা বাঘের মতো ভয় করে। আর এই স্যারই বলতে গেলে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন তাঁর অপার স্নেহমাখা শাসন আর উৎসাহ দিয়ে। তিনি বুঝলেন আমার মাথা ভালো হলেও দুষ্টুমি আর চঞ্চলতা অনেক বেশি। তিনি আমার ইংরেজি হাতের লেখা দেখে বললেন, "তুই তো দেখি এখনো ইংরেজি লেখাই ঠিকমতো শিখিসনি।" বললেন, "আশ্রাব আলী আর বখতিয়ারের হাতের লেখা দেখেছিস, কত সুন্দর! ওদের লেখা নকল করে হাতের লেখা ঠিক করবি।" বলতে দ্বিধা নেই ক্লাস ফাইভে উঠে আমি নতুন করে ইংরেজি হাতের লেখা লিখতে শিখলাম।

 

হেডস্যার আমাদের ইংরেজি পড়ান। ক্লাস ফাইভেই শিখে ফেলেছি সব পার্টস অব স্পিচ। আমার ইমিডিয়েট বড়, ক্লাস এইটে পড়া ভাই তখন সেগুলো শিখছে হাইস্কুলে। কেবল ইংরেজি ভীতি দূর করাই নয়, ইংরেজির জন্য দারুন এক ভালোবাসা আমার মধ্যে তৈরি করে দিলেন মোতালেব স্যার। আমার ভাল ছাত্রত্বের প্রকৃত শুরু এই মোতালেব স্যারের কাছেই।

 

ক্লাস ফাইভের ভাল ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন করে ইংরেজিতে বাহাদুরি দেখানোর। নতুন ইংরেজি শব্দ শিখে ক্লাসের বন্ধুদের তা শুনিয়ে বাহাদুরির লোভ পেয়ে বসেছিল আমারও। নতুন শব্দ শিখেছি— পেটুক ইংরেজি গ্লাটন। যাকে আমরা পেটুক বলে ক্ষেপাই তার অগোচরে অন্যদের সেটা জানাই। এরপর এক টুকরো কাগজে 'আই অ্যাম আ গ্লাটন' লিখে কয়েক বন্ধু ষড়যন্ত্র করে সেটা সেঁটে দিই অই বন্ধুর শার্টের পেছনে। অন্যদের হাসাহাসিতে ও টের পেতে দেরি হয় না। ও তো রেগে আগুন। আমদের মধ্যে অলিখিত চুক্তি ছিল নিজেদের মধ্যে যাই হোক টিচারদের কাছে বিচার দেব না। ও সব ভুলে গিয়ে কাগজ নিয়ে সরাসরি হাজির হেডস্যারের কাছে। খানিক পরেই আমার ডাক পড়লো। ক্লাসের ফাঁকে হেডস্যার তখন অন্য দুই স্যারকে নিয়ে আমগাছের ছায়ায় খোশগল্পে মেতেছিলেন। স্যার আমাকে দেখেই রেগে জিজ্ঞেস করেন, "এটা তুই লিখেছস?" আমি ধরা পড়া অপরাধী। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে রহিম স্যার পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করেন, "অ্যাই, গ্লাটন মানে কী রে!" আমি চুপ করে থাকি। হেডস্যারের আপাত অগ্নিশর্মা চোখে মৃদু হাসি। হেডস্যার রহিম স্যারের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেন, "পেটুক।" আর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "অ্যাই, বদমাইশি না করলে তর পেটের ভাত হজম হয় না, না?" তারপর, হাতের কাছে থাকা বেত দিয়ে, আমার প্রসারিত হাতের তালুতে দু'টো বাড়ি দিয়ে বলেন, "এরপর এমন বদমাইশি করলে তোর পিঠের ছাল কিন্তু তুলে নেব। যা ভাগ এখান থেকে।"

 

যেতে যেতে শুনি রহিম স্যার বলছে, "গ্লাটন শব্দটা আজকেই প্রথম শুনলাম! ও এসব পায় কই?"


প্রাইমারি ও হাই স্কুলে এই পরম স্নেহশীল স্যাররা আমার কী জ্বালানোটাই না সহ্য করেছেন! চুরি করে মেজাজী বদমেজাজী স্যারদের সাইকেল নিয়ে কয়েক চক্কর বেড়িয়ে আসা, এপ্রিল ফুলে ফাউন্টেন পেনের নিভ খুলে স্যারকে সে কলম দিয়ে তার নিজের হাতে টেবিলে রাখা খাতা, নিজের জামা কালিতে ভাসিয়ে দেয়া কিংবা কারো খাতায় নকল করে স্যারের সই দিয়ে দেয়া— এসব অমার্জনীয় অপরাধের কথা এখন মনে হলে গা শিউরে ওঠে। তারপরও কীভাবে এতো প্রশ্রয়, ভালোবাসা, উৎসাহ আর প্রশংসা পেয়েছি আমার শ্রদ্ধেয় কিছু শিক্ষকের কাছে!

 

গলাকাটা বাজারের স্কুলে ৮/১০ জনের ক্লাসে সেকেন্ড হওয়া আমি কালুর স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হয়েছি। তৎকালীন এমপি আবুল হাশেম সাহেব (মরহুম) তার প্রতিষ্ঠিত পল্লী উন্নয়ন সংস্থা (পউস) থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করতেন এক মেধাবৃত্তির। সে বৃত্তির পুরস্কার ছিল একটা খাসি। তাই এটি খাসি বৃত্তি নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিল। গোটা গফরগাঁও থানায় আমি সে বছর বৃত্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম। মনে পড়ে ১৯৭৪ এ সেই বৃত্তি বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুস সামাজ আজাদ। বৃত্তি বিতরণের পর দেশবিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে হয়েছিল 'নাচেগানে ভরপুর' জম্পেস বিচিত্রা অনুষ্ঠান। সেই ছোটবেলায় আপেল মাহমুদ, খোরশেদ আলমের কন্ঠে গান শোনা এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

 

স্কুলের একমাত্র ছাত্র হিসেবে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর হেডস্যার অন্য স্যারদের আমার সামনেই বলেছেন, "এই টিপু যখন আমাদের স্কুলে এসেছে তখন ও ঠিকমতো ইংরেজি হাতের লেখা লিখতো পারতো না। ওকে হাত ধরে আমি লেখা শিখিয়েছি।" একই কথা তিনি বলেছেন আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট শুনেও। নিজের সেই অক্ষমতার খোটা শুনে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি কখনো। বরং, নিজের মধ্যে মেধা আছে এবং চেষ্টা করলে আমি ভাল করতে পারি— এই বোধ নিজের অজান্তেই আমার মধ্যে উপ্ত করেছিলেন মোতালেব স্যার— স্নেহময় শাসন, প্রশংসা সবকিছু ঢেলে দিয়ে। ছাত্রের সাফল্যে শিক্ষকের অবদানে গর্বিত স্যারের উজ্জ্বল মুখটা সারাজীবনের জন্য আমার মনে গেঁথে আছে। অথচ, এই স্যারের নিজের সন্তানরা সেই অর্থে সফল হয়নি জীবনে। চট্টগ্রামে চাকরি করার সময় হঠাৎ একদিন স্যার তাঁর বড় ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন, সাথে একটি চিরকুট যার মূল কথা, "ছেলেকে নিয়ে সমস্যায় আছি। পারলে ওর জন্য কিছু করো।" ছাত্রের কাছে পুত্রের জন্য চাকরি চাওয়া নিশ্চয়ই একজন আত্মসচেতন, ব্যক্তিত্ববান স্যারের জন্য প্রীতিকর ছিল না।

 

ছাত্রগর্বে গর্বিত শিক্ষকের উজ্জ্বল মুখের বিপরীতে সেই মুখটা কল্পনা করে আমি কষ্ট পেয়েছি। আবার স্যারের ছেলের সাথে বিছানাপত্র দেখে বুঝতে পেরেছি কত বড় বিশ্বাস নিয়ে তিনি সন্তানকে তার প্রিয় ছাত্রের কাছে পাঠিয়েছেন। পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা আমি সেদিন স্যারের সেই বিশ্বাস, সেই প্রত্যয়ের মর্যাদা দিতে পেরেছিলাম।
লেখক: ড. মুনিরুছ সালেহীন, সাবেক সিনিয়র সচিব, কবি ও প্রাবন্ধিক।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)

১৬৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
ফেবু লিখন নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন