সর্বশেষ

ফেবু লিখন

কুমারখালী থেকে লিখছি

কাজী আখতার হোসেন
কাজী আখতার হোসেন

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:২২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
৪ সেপ্টেম্বর বিকেল দুটোয় কুমারখালী এসে পৌঁছেছি। সন্ধ্যায় কুষ্টিয়াতে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ জন্য। ভাই বোনদের বাসায়।

আমাদের শৈশবের বা কৈশোরের কুমারখালী এখন আর নেই। লোকসংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট। তবে অতীতকাল থেকেই কুমারখালী ব্যবসায়ী নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকেই। সেই সময়ে কাঙাল হরিনাথের পরিচয় দিতে বললেই বলা হত কুমারখালী গ্রামের মানুষ।

কুমারখালীর তরুণদের কিছু কিছু কান্ড আমার খুবই ভালো লাগে। ইতিহাসখ্যাত কুন্ডু পাড়ার বিশাল বিশাল অট্টালিকার ভেঙে যাওয়া পুরনো ভবনগুলো তারা অনলাইনে প্রচার করছে। ভিডিওতে দেখানোর চেষ্টা করছে শত বছরের প্রাচীন সব ভবনগুলো। একজন তো লিখেই বসেছেন, এগুলো কলকাতার সেই সময়ের ভবনের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

ভুবন ডাঙ্গার মাঝি সিনেমার শুটিং হয়েছে এই এলাকায়। আমার বাড়ির পাশে পুতুল বাড়ি, এখন এটি কুমারখালী পুলিশ ফাঁড়ি।


বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই পুতুল বাড়ি বলতে চিনতে পারে না। পুতুলগুলো নিয়ে নানা ব্যাখ্যা আছে। কেউ বলছেন, জমিদারদের শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক। পুতুলগুলোর ছিল দাড়ি। অনেকে ব্যাখ্যা করেন, মুসলমানদের কাজই ছিল দারোয়ান বা চাকর। এগুলো দিয়ে এসব বিষয় ফুটিয়ে তোলা হত।

আমাদের কিশোর বয়সে এই শহরে কোনও কলেজ ছিল না। স্কুলগুলো ছিল সব সময় খেলাধুলা, রবীন্দ্র-নজরুলের জয়ন্তী, নাটক ইত্যাদিতে ভরপুর। আমি আগেও লিখেছি, এক দিন কুমারখালী এমএন হাইস্কুল বনাম জেএন হাই স্কুলের খেলা হতো, সেদিন উত্তেজনায় ঘুমও এসে যেত না। পরবর্তী জীবনে অনেক ফুটবল খেলা দেখেছি, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতার মতো উত্তেজনা আর পাইনি।

কিছু নির্দিষ্ট স্থানে নাটক মঞ্চায়ন হতো—বেলতলা, মধু বাবুর দালান, অ্যামেচার ক্লাব ও আরও কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গায়।


সেই সময় ছেলেরা নারীর অভিনয় করতেন, শাড়ি পরে মেকআপ নিয়ে পুরোপুরি নারী হয়ে যেতেন। নিমাই দা, নুরুল ইসলাম, নিলু ভাই, জেসমিন কবির, টুনু—এসব মঞ্চে পুরোদস্তর নারী সেজে অভিনয় করতেন। কণ্ঠস্বরটাও কিছুটা মেয়েদের মতো করার চেষ্টাও করতেন।

তখন আমি অবাক হয়ে নাটকের অভিনয় দেখতাম। নাটক শুরুতে মাঝে মাঝে দেরি হতো, ফলে হুড়োহুড়ি বেঁধে যেত। যতদূর মনে পড়ে, একবার বেলতলায় কেউ একজন আরেকজনকে ছুরি মেরেছিল।

কুমারখালীর কিছু মানুষ তখন নাটক লিখতেন—সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান রানা ভাই, মনসুরুল আলম জিন্নাহ। এরা ছিলেন পরিচিত নাট্যকর্মী। এর মধ্যে আবু তৈয়ব প্রচুর লিখতেন, আর আক্কাস আলী পরবর্তীতে সিনেমা জগতে অভিনয় করেন।


প্রখ্যাত অভিনেতা মরহুম রাজু আহমেদ কুমারখালীর বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করতে দেখেছি শৈশবে। স্বাধীনতার পর মগবাজার রেল ক্রসিং এলাকায় রিকশায় আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। একই রিকশায় ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার শ্রী কল্যাণ মিত্র, যিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান।

পরে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন কুষ্টিয়া সাহিত্য পরিষদের নির্বাহী সদস্য ছিলাম। সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন শ্রী কল্যাণ মিত্র।


বিকেল ও সন্ধ্যাটা কুষ্টিয়ায় কাটাতাম অনেক সময়। কুষ্টিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একজন ছিলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শ ম শওকত আলী, নুরুল ইসলাম চৌধুরী কেটু স্যার, আবুল আহসান চৌধুরী, আব্দুর রশিদ চৌধুরী—আরো অনেকের নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। মাঝে মাঝে ডক্টর আনোয়ারুল করিম স্যারও দেখেছি। আনোয়ারুল করিম স্যার সবসময়ই সাদা মনের মানুষ, হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত।

কুমারখালী পৌর এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় নাটক ও নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী হত। সেই সময়ের অনুষ্ঠানগুলোতে আমি লক্ষ্য করতাম, গানের পরে যখন আবৃত্তির ঘোষণা আসত, তখন মানুষ হৈচৈ করে উঠত। আমার পক্ষপাত কেন যেন ছিল আবৃত্তির প্রতি। আমি চাইতাম মাঝে মাঝে আবৃত্তি হোক।

সত্যি বলতে, কুমারখালী সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় কুমারখালীর মতো একটি থানা শহরে যে আন্দোলন হয়েছিল, অন্য কোথাও হয়েছে কি না জানি না।

আমরা যখন ক্লাস নাইনে ছিলাম, তখন "পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি" নামে একটি বই পড়তাম। এর বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
কুমারখালীতেও দুর্বার আন্দোলন হয়। আমাদের চেনাজানা দু-একজন গ্রেপ্তার হয়, নাম বলছি না।

একসময় কুমারখালী পাবলিক লাইব্রেরী ছিল আমাদের নানা কিছুর কেন্দ্রবিন্দু—বিশেষ করে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। গুরুত্বপূর্ণ কেউ এলে আমরা এখানেই বসতাম। এখন পাবলিক লাইব্রেরির আশেপাশে এত দোকানপাট গড়ে উঠেছে যে, লাইব্রেরী চেনাই কষ্টসাধ্য।

অবশ্যই, শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্বাভাবিক। ঢাকায় যখন কেউ আমাদের বলেন, "তোমাদের বাড়ি কুমারখালী," আমি চিনতে পারি না। হয়তো তারা গ্রাম থেকে নতুন করে বসতি গড়েছেন।

কুষ্টিয়া শহরের মহল অনেকেই জানেন, যে কুষ্টিয়ার গর্ব করে যারা বলে তারা মূলত জন্ম বা কর্মস্থল কুমারখালী। ব্রিটিশ আমল থেকেই কুমারখালী একটি বুনিয়াদী নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কুমারখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য কুষ্টিয়ার চেয়ে গর্বের। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে কুমারখালী এগিয়ে ছিল।

একসময় ঈদ, পূজা, বিবাহ উৎসবের সময়ে মানুষ কুষ্টিয়ার কাছ থেকে এসে কুমারখালীতে বাজার করতেন।

তবে ইঁট-পাথর নয়, নয় সুরম্য দালান-কোঠা, বরং হারিয়ে গেছে সেই অতীতের প্রাণ, যা স্পর্শ করতো মানুষের মন। কুমারখালী স্পোর্টিং ক্লাবের বিশাল ফুটবল প্রতিযোগিতা, পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতি উৎসব, নাট্য মঞ্চায়ন ও মানুষের মধ্যে ভালোবাসা—এসব যেন এখন অতীতের স্মৃতি। স্কুলগুলো মুখরিত হোক খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক উৎসবে। যদিও শিক্ষা প্রথম অগ্রাধিকার, মাঝে মাঝে মনে হয়, "এবার ফেরাও মোরে।"
লেখক: কাজী আখতার হোসেন, সাবেক সচিব
(লেখাটি তাঁর ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)

১৭১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
ফেবু লিখন নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন