আগামী সরকারের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তে প্রশ্ন টিআইবি'র

বৃহস্পতিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:৩৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
নতুন নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের জন্য ৬০টি বিলাসবহুল মিতসুবিশি পাজেরো (QX-2427 সিসি) গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রতিটি গাড়ির মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে শুধু এই ৬০টি গাড়ি কিনতে সরকারের ব্যয় হবে ১০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে আরও ২২০টি যানবাহন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৫টি পাজেরো জিপ এবং ২৫টি মাইক্রোবাস। সব মিলিয়ে ২৮০টি গাড়ি কিনতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৪৫ কোটি টাকা।
ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনা উপেক্ষিত
অথচ চলতি অর্থবছরের শুরুতেই অন্তর্বর্তী সরকার একটি পরিপত্র জারি করে নতুন গাড়ি কেনা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, কেবলমাত্র ১০ বছরের বেশি পুরনো, অকেজো গাড়ির বিকল্পে অর্থ বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে যানবাহন কেনা যাবে।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যবহৃত মন্ত্রীদের গাড়ির বয়স ৯ বছর, অর্থাৎ পরিপত্রে উল্লেখিত শর্ত পূরণ করে না। ফলে এ সিদ্ধান্তকে ব্যয় সংকোচনের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টিআইবির প্রশ্ন: ‘পরবর্তী সরকারের জন্য গাড়ি কেনার অধিকার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই’
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
“পরবর্তী সরকার কী গাড়ি ব্যবহার করবে, তা নির্ধারণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এটি তাদের ম্যান্ডেটের মধ্যে পড়ে না। এই সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে বাতিল করা উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “এতে কেবল কৃচ্ছ্রসাধনের পরিপত্র উপেক্ষিত হচ্ছে না, বরং ভবিষ্যৎ সরকারের ওপর আগাম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা অগণতান্ত্রিক।”
কোন আইন ভেঙে কেনা হচ্ছে জিপ গাড়ি?
বর্তমান আইন অনুযায়ী, মন্ত্রীদের জন্য একটি সেডান কার বরাদ্দ থাকে। জিপ বা এসইউভি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে কেবল জরুরি দাপ্তরিক সফরের সময়। ফলে আইন সংশোধন ছাড়া ৬০টি পাজেরো জিপ কেনার সিদ্ধান্ত আইনি প্রশ্নও তৈরি করেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, “আইন অনুযায়ী, জিপ ব্যবহার করতে হলে তা অতিরিক্ত গাড়ি হিসেবে হতে হবে। মূলত মন্ত্রীদের জন্য সেডান কারই নির্ধারিত। তাই নতুন আইন সংশোধন ছাড়া এসব জিপ কেনা আইনসঙ্গত নয়।”
মন্ত্রী কতজন হবেন, তা আগেই কীভাবে জানা গেল?
নতুন সরকারের জন্য কেনা হবে ৬০টি গাড়ি—এই সংখ্যাটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, ভবিষ্যতের মন্ত্রিসভায় সর্বোচ্চ ২৩ জন মন্ত্রী ও ১২ জন প্রতিমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু কেন ৬০টি গাড়ি?
নতুন মন্ত্রিসভা গঠন বা সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে পূর্বধারণা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
আগে কেনা গাড়ির ইতিহাস ও দাম
২০১৫-১৬ অর্থবছরে মন্ত্রীদের জন্য কেনা হয়েছিল টয়োটা ক্যামরি (২৫০০ সিসি) গাড়ি, প্রতিটির দাম ছিল ৮৫-৯০ লাখ টাকা। প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের জন্য আনা হয়েছিল মিতসুবিশি ল্যান্সার (১৬০০ সিসি), যার দাম ছিল ২০-২৫ লাখ টাকা। সেই তুলনায় এবার পাজেরো জিপের প্রতিটির দাম প্রায় দ্বিগুণ।
নির্বাচন উপলক্ষে কেনা হচ্ছে আরও ২২০টি গাড়ি
আগামী নির্বাচনে ইউএনও এবং ডিসিদের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে ১৯৫টি পাজেরো এবং ২৫টি মাইক্রোবাস কেনার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জিপের দাম ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং প্রতিটি মাইক্রোবাসের দাম ৫২ লাখ টাকা।
যানবাহন অধিদপ্তরের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে ৩২৮ কোটি টাকা। কিন্তু নতুন ২৮০টি গাড়ি কিনতে ব্যয় হবে ৪৪৫ কোটি টাকা। এই বাড়তি অর্থ অন্য খাত থেকে সরিয়ে ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ উপদেষ্টার অনুপস্থিতিতে নীরবতা
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিদেশ সফরে থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারও এ বিষয়ে মুখ খুলেননি। তবে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, গত ৬ আগস্ট একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে নতুন সরকারের জন্য গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান সভাপতিত্ব করেন। তিনি জানান, “পুরনো গাড়িগুলো প্রায়শই বিকল হয় এবং ব্যয়বহুল মেরামতের প্রয়োজন হয়। এ কারণে নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”
সরকারি গাড়ি কেনা নিয়ে এই সিদ্ধান্ত শুধুই আর্থিক নয়, রাজনৈতিক ও নীতিগত প্রশ্নও তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন উপেক্ষা করে এবং ভবিষ্যৎ সরকারের ম্যান্ডেট ধরে নিয়ে এ ধরনের ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচারের পরিপন্থী।
১৫১ বার পড়া হয়েছে