২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
৪৯ জন আসামি- রাজনীতিক, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবাই মুক্ত

বৃহস্পতিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:২৯ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় ঘটে যায় স্বাধীন বাংলা ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস রাজনৈতিক হামলা—গ্রেনেড বিস্ফোরণ।
শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত এই নারকীয় হামলায় নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী এবং আহত হন শতাধিক। সেদিনের বিভীষিকা দেশের বিচার, তদন্ত, এবং ন্যায়বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে যা পরবর্তী দুই দশক ধরে জাতির রাজনৈতিক ও মানবিক চেতনায় গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছে। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এই হামলার বিচার-পদ্ধতি, তদন্তের ত্রুটি, জাল স্বাক্ষী, দীর্ঘদিন নির্দোষ ব্যক্তিদের কারাভোগ, এবং চূড়ান্তত আপিল বিভাগের রায় হয়েছে ৪ সেপ্টেম্বর।
ঘটনার বিবরণ
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষ করার মুহূর্তে অস্থায়ী মঞ্চ লক্ষ্য করে একে একে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। এতে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন এবং আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক মানুষ।
ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন ১২ জন, বাকিদের মৃত্যু হয় পরবর্তী চিকিৎসাকালে।আহতদের অনেকে আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করেন।
মামলা ও তদন্তের ইতিহাস
ঘটনাটির পর পরই হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। তদন্তের শুরুতে পুলিশ ‘জজ মিয়া’ নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে জাল স্বীকারোক্তি আদায় করে, যা তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকার পরিবর্তন ও সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নতুন তদন্ত আসে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা পেলে, পুনঃতদন্তে প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং আরও বহু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তির নাম আসে। মামলায় মোট আসামি ৪৯ জন, যাদের মধ্যে বেশ অনেকে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন এর মধ্যে অনেকে পলাতক ছিলেন।
বিচারিক আদালতের রায়
২০১৮ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন, ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেন।মূল আসামিদের মধ্যে ছিলেন তারেক রহমান, বাবর, সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরী, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ব্যাপক আলোচনার সাথে মামলার সাক্ষ্য ও তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে—সাক্ষীদের অধিকাংশই সরাসরি পরোক্ষ ছিলেন, যার ফলে তদন্তের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তোলে।
হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়
হাইকোর্ট: ২০২৪ সালের রায়ে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে সকল আসামিকে খালাস দেয় এবং ডেথ রেফারেন্স ও আপিল মঞ্জুর করে। তদন্তের ত্রুটি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, শোনাসাক্ষ্য ও প্রত্যক্ষ তথ্যের ঘাটতি ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করে খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্তের স্বাধীনতা না থাকা, জাল স্বীকারোক্তি, নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসানো নিয়ে দ্ব্যর্থহীন সমালোচনা করে। পুনঃতদন্তের নির্দেশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
আপিল বিভাগ: ২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সব খালাসের রায় বহাল রাখে, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে। মামলায় তদন্ত এবং সাক্ষী প্রমাণে গুরুতর ত্রুটি ছিল, জাল স্বাক্ষী, নির্দোষদের দীর্ঘদিন কারাগারে রাখার ওপর তীব্র সমালোচনা করে। আদালত বলেন, “এত বড় ঘটনার প্রকৃত বিচার ও সত্য উদঘাটন হয়নি, এতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়েছে।” পুনঃতদন্তের নির্দেশনা আর কার্যকর নয়, চূড়ান্ত খালাস ঘোষণা করেন। মামলায় জাল স্বাক্ষী ও তদন্তে ভুলের জন্য কারও বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আপিল বিভাগ বলেনি, শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চূড়ান্তভাবে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামির তালিকা
১৯ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, ১৯ জন যাবজ্জীবনের দণ্ডপ্রাপ্ত, আরও ১১ জন পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা—সবাই এই রায়ে খালাস পেয়েছেন।
তারেক রহমান (বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান), লুৎফুজ্জামান বাবর (সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), হারিছ চৌধুরী (বিএনপি নেতা), আবদুস সালাম পিন্টু (সাবেক উপমন্ত্রী), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন (বিএনপি নেতা)। আরও ১১ জন: এসপি রুহুল কুদ্দুস, এসপি ফারুক আহমেদ, এসপি কাইয়ুম খান, এএসপি আব্দুর রশিদ, এএসপি আব্দুস সালাম, এসআই মু. বদরুল করিম, এসআই শফিকুল ইসলাম, এসআই আজিজুল ইসলাম, এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন, এক জন সেনা কর্মকর্তা (নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সহায়তাকারী)।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন
আদালত বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছে, তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব, জাল স্বাক্ষী, নির্দোষদের ফাঁসানো এবং তদন্তে স্বচ্ছতা না থাকার জন্য প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হয়নি।বিচার বিভাগের মন্তব্য ছিল, “তদন্তের ত্রুটি ও সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে কোনো অপরাধী সনাক্ত হয়নি—তাদের জীবন নষ্ট হয়েছে।” মামলার চূড়ান্ত রায়ে কেউ শাস্তি পায়নি, পূর্ণাঙ্গ খালাস হয়েছে।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষে তদন্তের গুরুতর ত্রুটি, জাল স্বাক্ষী, নির্দোষদের দীর্ঘদিন কারাগারে রাখার কষ্ট, এবং আদালতের নির্দিষ্ট কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চূড়ান্তভাবে সব আসামিকে খালাসের রায়—বিচার বিভাগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল বিভাগ ও বিচারিক আদালত সর্বোচ্চ সতর্কতা, আইনি যুক্তি এবং প্রমাণের বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছেন। সংবিধান ও বিচারব্যবস্থার নির্ধারিত সীমার মধ্যে বিচারিক কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং পুনর্বিবেচনার সুযোগ ও তদন্তের ত্রুটি আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। চূড়ান্তভাবে সকল আসামির মুক্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে আইনের শাসন ও আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে এই মামলার বিচারিক অধ্যায় শেষ হয়েছে। ন্যায্যতার স্বার্থে আদালতের রায়ই চূড়ান্ত; সকল সংশয় ও ব্যক্তিগত মতামত পরিহার করে দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা এবং আইনি সম্মান বজায় রাখাই কাম্য।
২৬৮ বার পড়া হয়েছে