ইনাম-আল- হক: কুস্টিয়ার গর্ব, দেশের সম্পদ

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১০:৫১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২৫ আগস্ট ১৯৪৫ সালে ইনাম আল হক কুষ্টিয়া জেলার হিজলাবট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইউসুফ আলী। মায়ের নাম কানিজ ফাতেমা। গড়াই নদী তার ছোটবেলাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে।
ছোটবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করতেন তিনি। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে বেড়ে উঠেছেন তিনি। চারপাশের প্রকৃতি, পাখি আর বন্যপ্রাণের অনুভূতি তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে। শৈশবে একটি খাঁচায় বন্দি পাখি তাঁকে পাখির প্রতি কৌতূহলী এবং দরদী করে তোলে। সেই থেকেই শুরু প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। পড়াশোনায়ও তিনি ছিলেন চৌকষ। স্কুলে প্রথম হওয়ায় পুরস্কার হিসেবে হাতে আসে লিও টলস্টয়ের "দ্য প্রিজনার অব দ্য ককেশাস" বই। এ বইই তাঁর পাঠাভ্যাসকে পাকাপোক্ত করে। মাত্র নয় বছর বয়সে স্কুলের সামনের লাইব্রেরিতে তিনি নিয়মিত নানা জাগতিক কৌতুহলের বই পড়তেন, সেই থেকে বইয়ের প্রতি যে ভালোবাসা জন্মেছিল তা আজও অটুট। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথমবার পত্রিকায় ছড়া প্রকাশিত হয়। চাঁদে মানুষের অবতরণ নিয়ে লেখা প্রবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপা হয়। লেখক জীবনের শুরু সেখানেই থেমে যায়নি, বরং বছর বছর তা গভীর হয়েছে। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিকেশন-ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ইনাম আল হক ১৯৬৭ সালে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তার দুই বছর পরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অ্যারোনিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বন্দী বিনিময় চুক্তির ফলে মুক্তি পান। ১৯৯৫ সালে বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার হিসেবে অবসর নেন। পরবর্তীতে ব্র্যাক এবং জি কিউ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে কাজ করেন। ২০০৫ সালে চাকুরি জীবন থেকে অবসর নেন। সকল চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি পুরোপুরিভাবে পাখি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
ইনাম আল হকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো "বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব" প্রতিষ্ঠা। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি পাখিপ্রেমী এবং গবেষকদের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এই ক্লাবের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে পাখি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা এবং সংরক্ষণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি নিজ বাসায় "বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব" প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালে তার গঠিত এভারেস্ট টিমের চারজন সদস্য এভারেস্ট জয় করেন। আরও অনেকে হিমালয়ের বিভিন্ন চূড়ায় আরোহণ করেন। তার এই ক্লাবটি আজও হিমালয় ছোঁয়ার সাহস জাগাচ্ছে অনেক যুবক, তরুণদের। তিনি প্রথম বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন, যিনি অ্যান্টার্কটিকা ও উত্তর মেরু ভ্রমণ করেছেন। নিজের ৬২তম জন্মদিনে উত্তর মেরুতেই দৌঁড়েছিলেন ম্যারাথন। তিনি বাংলাদেশে নিয়মিত পাখি শুমারির (Bird Census) প্রবর্তন করেন, যা দেশের পাখির সংখ্যা ও প্রজাতির বৈচিত্র্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। এই তথ্য পাখি সংরক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়নে অত্যন্ত সহায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল ও হাওর এলাকায় প্রতি বছর পাখি শুমারি পরিচালিত হয়। পাখি শনাক্তকরণের জন্য পাখির পায়ে রিং পরানোর (Bird Ringing) মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও তিনি বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন। এর মাধ্যমে পাখিদের পরিযান পথ, জীবনকাল ও আচরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়।
এছাড়াও তিনি দেশের বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যময় এলাকা যেমন—হাওর অঞ্চল, সুন্দরবন, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলে গবেষণা পরিচালনা করেন। এসব গবেষণা শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, নীতিনির্ধারকদের জন্যও মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছে। পাখি ও প্রকৃতি নথিভুক্তির ক্ষেত্রে ইনাম আল হকের অবদান অনন্য। তিনি অসংখ্য দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন, যা বাংলাদেশের পাখিজগতের এক জীবন্ত দলিল হিসেবে কাজ করছে। লেখালেখির ক্ষেত্রে তাঁর সহজবোধ্য ভাষা ও জীবন্ত বর্ণনা সাধারণ পাঠককে পাখি ও প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে — ‘বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড’, ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’ ও ‘রূপসী বাংলার পাখি’। এই বইগুলো বাংলাদেশের পাখিজগতের সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ করেছে এবং গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্যই নয়, বরং পাঠকদের হৃদয়ে পাখিদের জন্য ভালোবাসা ও সহানুভূতি তৈরি করেছে।
কোনো পুরস্কারের আশা নিয়ে ইনাম আল হক কখনো কোনো কাজ করেননি। তবে তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা বহু পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০২৩), যা পরিবেশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির জন্য প্রদান করা হয়, এবং জাতীয় পরিবেশ পদক—বাংলাদেশ সরকার তাকে পরিবেশ সংরক্ষণে তার ভূমিকার জন্য ভূষিত করেছে। আসলে, যে কোনও পুরস্কারই তাঁর সমকক্ষ নয়। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। হিমালয় ছোঁয়ার অভিযাত্রার কারিগর, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র ও প্রকৃতি সংরক্ষণের ইতিহাসে ইনাম আল হকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ঢাকাস্থ খোকসা উপজেলা কল্যাণ সমিতি বছর সাতেক আগে জাতীয় যাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে তাকে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে সম্মানিত করেছিল। সম্ভবত: কুস্টিয়া বাসীর পক্ষ থেকে এটাই তাকে সম্মানিত করা। এতে তিনি অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। সেটি একদমই যথেষ্ট নয়। আমি কুস্টিয়া জেলা সমিতি, ঢাকা এবং কুস্টিয়া শহরের কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে বড় পরিসরে তাকে সম্বর্ধিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।*
[তথ্যঋণ: জনাব মহসিন উল হক এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখা থেকে]
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
১৭২ বার পড়া হয়েছে