কেন নিউ টাউন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৪:৫৮ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক বিশেষ দিন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপর্যায়ে নতুন এক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
সেই সময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে, বিশেষত রাজধানী ঢাকার অভিজাত ও আধা-অভিজাত এলাকাগুলোতে নানা ধরনের অস্থিরতা ও সংঘর্ষ দেখা দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে নিউ টাউন এলাকার কয়েকজন সচেতন নাগরিকের একান্ত প্রচেষ্টায় সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “নিউ টাউন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট, আমিরুল মিল্লাত মহিলা কামিল মাদ্রাসা মসজিদে এশার নামাজ শেষে, তাসমিয়া গার্ডেন অফিস কক্ষে এলাকার সার্বিক অস্থিরতা ও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম আমি, মো:মোতাছিম বিল্লাহ, মো:আবু জাফর এবং মো:জসিম উদ্দিন সিকদার।
সাথে সাথে মো:আবু জাফরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নিউ টাউন বাসিকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসে একটি ঐক্যবদ্ধ জনমত গঠন করার। মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মো:আবু জাফর ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে নিউ টাউন সোসাইটি নামে একটি whatsapp গ্রুপ ক্রিয়েট করেন। গ্রুপে মানুষজন তাদের এলাকাভিত্তিক ও রোড ভিত্তিক সমস্যাগুলো তুলে ধরতে শুরু করে এবং আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হতে থাকে।
পরবর্তীতে কাজের ব্যাপ্তি ও পরিধি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সামাজিক সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে স্থানীয় ভাবে অনেকগুলো সালিশি বৈঠক করতে হয় আমাদের। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে প্রায় তিন দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কার্যকর উপস্থিতি ছিল না। এর ফলে বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি, ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে হামলা, ভিন্নমতের ওপর চড়াও হওয়া, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে দাঙ্গা ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। নিউ টাউন এলাকাও এই পরিস্থিতি থেকে বাদ যায়নি। আবাসিক এই অঞ্চলে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে অনিরাপদ,অশান্ত ও অনিশ্চিত।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সমাজে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, সেখানে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দ্রুত বিস্তার লাভ করে।” নিউ টাউনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল— রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয় অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় দ্বন্দ্বগুলো প্রবল আকার ধারণ করে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হয়েছিল স্থানীয় পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধতা ও অহিংসভাবে সংগঠিত থাকা।
আলোচনার একপর্যায়ে সবাই উপলব্ধি করি যে এই অশান্ত পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীকে শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য একটি স্থায়ী সামাজিক সংগঠনের প্রয়োজন। সেই বৈঠকেই নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় একটি সংগঠন গড়ে তোলার, যার নাম হবে “নিউ টাউন সোসাইটি”।
নামকরণের যথার্থতাঃ নামকরণের সময় সবাই এ বিষয়ে একমত হন যে, সংগঠনটি শুধু অস্থায়ী উদ্যোগ নয়, বরং নিউ টাউনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা পালন করবে। তাই এলাকাবাসীর পরিচিতি ও ঐক্যকে সামনে রেখে এর নাম রাখা হয় "নিউ টাউন সোসাইটি"। সামাজিক সংগঠনের নাম সাধারণত পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি একটি ভৌগোলিক, সামাজিক ও মানসিক ঐক্যের প্রতিফলন বহন করে।
নিউ টাউন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সময় প্রাথমিক যে উদ্দেশ্যগুলো সামনে আনা হয়েছিল, তা হলো—আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পারস্পরিক সহযোগিতা করা, দখলবাজি ও অরাজক কার্যকলাপ প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া,ভিন্ন মতের মানুষের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা, এলাকার শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা, সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করা।
সাধারণ জনগনের সার্বিক চাহিদা বিবেচনা করে সকল এলাকার লোকজনদেরকে নিয়ে ১৯ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে আসরের নামাজের পরে নিউ টাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করে সোসাইটির না না ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য মুফতি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। জনাব নেছার উদ্দিন আহাম্মদনকে সভাপতি ও মো: আবু জাফরকে সদস্য সচিব করে সোসাইটির দৈনন্দিন কাজগুলো পরিচালনা করার জন্য ৩১ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।
একটি সমাজ যখন হঠাৎ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়, তখন সেখানে “কমিউনিটি-বেইজড ইনস্টিটিউশন” বা স্থানীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। গবেষণা বলছে, সামাজিক সংগঠনগুলো সংকটময় সময়ে মানুষকে সংগঠিত করে এবং সামাজিক মূলধন (Social Capital) তৈরি করে। নিউ টাউন সোসাইটি সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এটি শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং সমাজের ভাঙনের বিপরীতে ঐক্যের প্রতীক।
নিউ টাউন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উদ্যোগের দলিল। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন ব্যর্থ হয়, তখন স্থানীয় জনগণই নিজেদের ঐক্য ও সচেতনতার মাধ্যমে শান্তি,শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠিত এই সোসাইটি আজ নিউ টাউনের জনগণের জন্য শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং সংহতি, সহযোগিতা ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতীক। নিউ টাউন সোসাইটির সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। দিন দিন সাধারণ মানুষের মাঝে এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যাপকতা বেড়েই চলছে। আগামী তিন বছরের জন্য নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ কে স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও জবাবদিহিতার সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে দল-মত,পথ,ধর্ম-বর্ণ,রাজনীতি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আপামর শ্রেণী পেশার জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
১৩৭ বার পড়া হয়েছে