সর্বশেষ

প্রবাস

মাফিয়াদের হাতে বন্দী ছিলেন, যেন জীবন্ত মৃত্যুকূপ, ফিরবার পথ নেই

স্টাফ রিপোর্টার
স্টাফ রিপোর্টার

বৃহস্পতিবার , ২১ আগস্ট, ২০২৫ ১:২৬ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
লিবিয়ায় দালাল ও মাফিয়াদের হাতে বন্দি হয়ে ৩০ লাখ টাকা খুইয়ে ফিরে এলেন নজরুল ইসলাম। হারিয়েছেন পরিবার, এখন ঋণের বোঝায় দিশেহারা। 

ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন লিবিয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে রূপ নেয় নজরুল ইসলামের জন্য। মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণা ও লিবিয়ার মাফিয়াদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে নিঃস্ব অবস্থায় ফিরেছেন দেশের মাটি ঝিনাইদহের এই যুবক।

বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন নজরুল ইসলাম। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ, শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন—সব মিলিয়ে তার করুণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মানবপাচারের ভয়াবহ বাস্তবতাকে।

২০২৩ সালে ইতালিতে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে একজন দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যান নজরুল। তার কাছ থেকে নেয়া হয় ১৬ লাখ টাকা। লিবিয়ায় পৌঁছেই সেই স্বপ্ন চুরমার হয়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে ব্যর্থ হলে তাকে ধরে বিক্রি করে দেয় লিবিয়ার এক দুর্নীতিগ্রস্ত নিরাপত্তাকর্মী।

এরপর নজরুল পড়েন স্থানীয় এক মাফিয়া চক্রের হাতে। শুরু হয় চরম নির্যাতন। তার পরিবারকে ভিডিও পাঠিয়ে চাঁদা আদায়ের জন্য চাপ দেওয়া হতো। অবশেষে জমিজমা বিক্রি ও ঋণ করে নজরুলের পরিবার মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয় আরও ১৫ লাখ টাকা।

নজরুল জানান, মাফিয়ারা তাকে হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মারধর করত। তিন মাস টয়লেটের পানি আর পচা রুটির ওপর নির্ভর করে বেঁচে ছিলেন তিনি। মাফিয়ারা হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলে সেই দৃশ্য ভিডিও করে পরিবারের কাছে পাঠাতো।

মুক্তির পরও শেষ হয়নি দুঃস্বপ্ন। নজরুলকে ঠাঁই দেওয়া হয় লিবিয়ার এক জেলখানায়, যেখানে পুলিশও প্রতিনিয়ত তাকে মারধর করত এবং টাকা ছিনিয়ে নিত। খাবার-দাবারের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

চরম এই অভিজ্ঞতার পর নজরুলের পরিবারও ভেঙে গেছে। স্ত্রী ও সন্তান তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আজ তিনি দেশে ফিরেছেন সর্বস্ব হারিয়ে, মাথায় ৩০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা।

তার অনুরোধ, "দেশে ভিক্ষা করেও বেঁচে থাকা ভালো। কেউ যেন এই পথে না আসে। এটা মৃত্যুপুরী। আমি শুধু না, পরিবারকেও শেষ করে ফেলেছি।"

নজরুল একা নন। বৃহস্পতিবার লিবিয়া থেকে ফিরেছেন আরও ১৭৫ বাংলাদেশি। অধিকাংশই বলছেন, তারা মাফিয়ার হাতে বন্দি ছিলেন বা জেলখানায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। লিবিয়ার কারাগার ও পাচারকারী চক্রে আটকা পড়া বাংলাদেশির সংখ্যা এখন শত ছাড়িয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টটেক্সের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বছর ৮ হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেন, যার মধ্যে ৭ হাজার ৫৭৪ জনই ছিলেন কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর রুটে।

আইওএম-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে লিবিয়া উপকূল থেকে আটক করা হয় ২১ হাজার ৭০০ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে। তাদের মধ্যে ছিলেন ১,৫০০ নারী ও ৭০০ শিশু। নৌকাডুবিতে নিহত হয়েছেন ৭০০’র বেশি মানুষ, যাদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশি।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি। ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আর ৯৩ শতাংশ বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন কিছু সময়।

বিশেষ করে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ এই পথে যাত্রা করে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছেন।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, “এই মানবপাচারের ঘটনায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা স্পষ্ট। প্রযুক্তির ব্যবহারে তারা পিছিয়ে। পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।”

নজরুল ইসলাম ও তার মতো আরও অনেকের বেদনাময় অভিজ্ঞতা সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশবাসীর জন্য। ইউরোপের স্বপ্ন দেখানোর নামে যেসব পাচারকারী মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

১২৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
প্রবাস নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন