এক দশকে মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল: দূর্নীতি, আইনের বাস্তবায়নে ঘাটতি ও সচেতনতার অভাব

বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০২৫ ৩:২০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য মহামারি আকার ধারণ করেছে। গত এক দশকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রায় ১,১০,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
শুধু ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল অন্তত ৮,৫৪৩; ২০২৫ সালের জুলাইতে প্রাণ গেছে অন্তত ৫২০ জনের। গত পাঁচ বছরে সর্বমোট দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৪,৮৯৪ জনের—এ সময়ে আহত হয়েছেন আরও ৫৯,৫৯৭ জন। বছর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যায় দেখা যায়, ২০১৮-২৩ পর্যন্ত প্রতিবারই ৬,০০০ থেকে ৮,৫০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই ভয়াবহতা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতিকে গভীর এক দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
মৃত্যুর এই মিছিলের সর্বাধিক দায় কার?
আইন নেই, নিয়ম আছে, কিন্তু প্রয়োগের অভাব চূড়ান্ত। দেশে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এবং সংশ্লিষ্ট পয়েন্ট ভিত্তিক লাইসেন্স সিস্টেম থাকলেও মাঠপর্যায়ে তার সফল বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, পরীক্ষামূলক পয়েন্ট কর্তন বা লাইসেন্স বাতিলের মামুলি প্রয়োগ কখনও কখনও চোখে পড়ে, তবে ডিজিটালাইজেশন ও স্বচ্ছ নীতিমালা নেই বলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি অব্যাহত। একই সঙ্গে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রধান্য, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং অপেশাদারিত্ব, এই ভয়াবহতাকে সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।
অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি
অধিকাংশ দুর্ঘটনার পেছনে আছে অযোগ্য চালক, অনুমোদনহীন ও প্রশিক্ষণবিহীন গাড়িচালনা। সঠিক প্রশিক্ষণ ও মানসম্পন্ন পরীক্ষার ঘাটতি থাকায় অসংখ্য চালক নিয়ম না জেনে এবং আইন না মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন। বিআরটিএর তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে ৫০,০০০ নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হলেও শিক্ষানবিশ এবং পরীক্ষার মান নিয়ে অভিযোগ আছে প্রায় ৩৫-৪০% আবেদনকারীর বিরুদ্ধে। শারীরিক-মানসিক দক্ষতা ছাড়াই গাড়িচালক হিসেবে রাস্তায় নামা নিয়ম ক্রমশ চরম সংকটের রূপ নিয়েছে।
সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহনও আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। পরিবহন মালিক-কর্মচারী সংগঠনের চাপে অসংখ্য যানবাহন পরীক্ষাবিহীন ও ফিটনেসবিহীন অবস্থায় রাস্তায় চলে। নানা যন্ত্রাংশ ও গতি নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি থাকার ফলে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনই ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়। বহু দুর্ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে, দ্রুতগতি, ত্রুটিপূর্ণ ব্রেক, হাই-স্পিড ইঞ্জিন, সরু রাস্তায় ওভারটেকিং—এসবই প্রাণহানির পিছনে রয়েছে।
বিআরটিএর লাগামহীন দুর্নীতি
বিআরটিএর (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) লাগামহীন দুর্নীতি সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ। লাইসেন্স, ফিটনেস ও রুট পারমিট পেতে ঘুষ এবং অসাধু লেনদেনের মাধ্যমে অযোগ্য চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন সহজেই সড়কে নামার সুযোগ পায়। এতে অনিয়ন্ত্রিত, অদক্ষ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের সংখ্যা বেড়েই যায়, আর দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর মনিটরিং ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সংস্কার, অবকাঠামো ও জনসচেতনতা
অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, পথচারীদের অসচেতনতা, ফুটপাথে হকার, ক্রসিং সংকট, সড়কের নির্মাণ ত্রুটি, সিগন্যাল ও সাইনেজের অভাব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। ফুটপাথের দখল, পথচারী ও চালকদের আচরণে অসচেতনতা, গন্তব্যে পৌঁছাতে হেলমেট, সিটবেল্টের ব্যবহার না করা—এসব সমস্যার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা কার্যত অপ্রতুল। গতি সীমা অমান্য, উল্টো পথে যাতায়াত, গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী-মালামাল, পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রী পরিবহন—সড়কে নিয়মভঙ্গ ও দুর্বলতার আরেক জট।
সামাজিক অর্থনীতিতে প্রভাব
এই নিরবচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরিণতি সমাজে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে। শত শত পরিবার প্রতিনিয়ত উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে, খরচ বাড়ছে, মানসিক বিপর্যয় ও শিশুর শিক্ষায় আঘাত আসছে। প্রত্যেক বছর পরিবারগুলো নিয়ে সামাজিক জরিপ বলছে, হতাহতদের ৫৫% পরিবার দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সংকটে পড়ে এবং প্রায় ৩০% পরিবার মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সম্মুখীন হয়।
করণীয় কী?
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ কৌশল হল কঠোর ও স্বচ্ছ আইন প্রয়োগ, ডিজিটাল লাইসেন্স ব্যবস্থা, অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের শাস্তি নিশ্চিতকরণ, প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া, গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত সচেতনতা কার্যক্রম চালু, এবং দুর্ঘটনার শিকার শিশু ও পরিবারকে দ্রুত পুনর্বাসন প্রকল্পে যুক্ত করা। ট্রাফিক আইন, গতি নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ ফুটপাথ ও জেব্রাক্রসিং, পথচারীদের আচরণ, এবং মালিক-শ্রমিক সংগঠনের সংঘাত-নিয়ন্ত্রণ—সবকিছু মিলিয়ে একটি যুগোপযোগী কার্যকরী পরিবর্তন ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহারে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। এখানে প্রতি বছর গড়ে ৮,৫০০–৯,৫০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুহার ১০২ জন, যা ভারত, পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে, মাথাপিছু ও যানবাহন অনুপাতে সড়ক দুর্ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
পরিশেষে
কোনো প্রকার সময় ক্ষেপন না করে, এখুনি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা, পরিবহন সংগঠন, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণকে সমন্বিত দায়িত্ব নিতে হবে। প্রশিক্ষিত চালক, আধুনিক সড়ক আইন, জনগণের সচেতনতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা—এই কয়টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়াতে হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। ট্রাফিক মৃত্যু রোধে নিঃশর্ত সদিচ্ছা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি সকল উদ্যোগ, জনসম্পৃক্ততা ও নীতিমালা পরিপালন না হলে, কেবল সংবাদ শিরোনাম হয়—দুঃসহ মৃত্যু আর কান্নার সংখ্যা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৬৯ বার পড়া হয়েছে