কেমন নিউটাউন সোসাইটি চাই

মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫ ৬:১৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
কাহলিল জিবরান তার সমাজ-দর্শনমূলক উক্তিতে বলেন- “You are the bows from which your children as living arrows are sent forth.” তোমরা হচ্ছ ধনুক, আর তোমাদের সন্তানরা জীবন্ত তীর, যাদের সমাজে এগিয়ে দেওয়া হয়।" এখানে সমাজ গঠনে পিতা-মাতা ও প্রবীণদের ভূমিকার দার্শনিক ব্যাখ্যা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ণ আমাদের জীবনধারা ও সামাজিক কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। শহর এখন কেবল কর্মক্ষেত্র নয়, বরং একটি বহুমাত্রিক জীবনের কেন্দ্র। আর এই শহুরে জীবনের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা আবাসিক সোসাইটিগুলো একদিকে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ও মানবিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা আবাসিক সোসাইটিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক সোসাইটি ব্যবস্থাপনা সংকট, অস্বচ্ছ নির্বাচন, দখলদারিত্ব ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত। প্রশ্ন জাগে—আমরা আসলে কেমন নিউটাউন সোসাইটি চাই?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের নাগরিক চাহিদা, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG), সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামী নৈতিকতা—সবগুলো বিষয় একসাথে বিবেচনা করতে হবে।
গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা-নিউটাউন সোসাইটির প্রথম শর্ত হলো বৈষম্যহীন গণতন্ত্র। সোসাইটির কমিটি যেন কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না হয়ে ওঠে। শিক্ষা ও যোগ্যতা নির্ভর জ্ঞান ভিত্তিক নেতৃত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা UNDP তাদের গবেষণায় বলেছে—“Good Governance ensures transparency, accountability, participation and rule of law.” অর্থাৎ একটি ভালো শাসনব্যবস্থা কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সোসাইটি বছরের পর বছর কমিটি পরিবর্তন করে না, অথবা নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। ফলে সাধারণ সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন। অথচ স্থানীয় শাসনব্যবস্থার সঠিক রূপায়ণ হলে প্রতিটি পরিবার নিজেকে সোসাইটির অংশ হিসেবে দেখতে পায়। যেমন, সিঙ্গাপুরের Resident Welfare Association মডেল অত্যন্ত কার্যকর—যেখানে প্রত্যেক বাসিন্দার মতামত ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। নিউটাউন সোসাইটির জন্যও একই রকম স্বচ্ছতা অপরিহার্য।
নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা-জাতিসংঘের SDG-16 বলছে—শান্তিপূর্ণ সমাজ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শহুরে সমাজে চুরি, ছিনতাই, মাদক ও কিশোর গ্যাং সমস্যায় অনেক সোসাইটি ভুগছে। রাজধানী ঢাকার নিউটাউন সোসাইটিতে তাই আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে—CCTV, প্রশিক্ষিত সিকিউরিটি গার্ড, প্রবেশ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এবং পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়।
এখানে শুধু বাহ্যিক নিরাপত্তা নয়, সামাজিক নিরাপত্তাও জরুরি। অভিভাবক ও তরুণদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা, মাদকবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং কিশোরদের জন্য খেলাধুলার আয়োজন হলে সোসাইটির অভ্যন্তরে অপরাধ কমে আসবে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়ন-একটি সোসাইটি তখনই জীবন্ত হয়, যখন তা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইউনেস্কোর এক গবেষণায় বলা হয়েছে—“Community-based learning reduces crime and increases social cohesion.” অর্থাৎ শিক্ষা ও সংস্কৃতি সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
নিউটাউন সোসাইটিতে শিশুদের জন্য লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, তরুণদের জন্য আইটি ও ভাষা প্রশিক্ষণ, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাংস্কৃতিক আসর ও ধর্মীয় আলোচনা হতে পারে। আব্বাস উদ্দিন, লালন, হাসান রাজা বা সুফি কবিদের গান ও দোআ মাহফিল সোসাইটির মানুষকে কেবল বিনোদনই দেবে না, বরং নৈতিক শক্তি জোগাবে।
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই অবকাঠামো-SDG-11 বলছে—“Make cities inclusive, safe, resilient and sustainable.” আমাদের শহরগুলোতে খোলা জায়গা ও সবুজ গাছপালা কমে গেছে। নিউটাউন সোসাইটিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, সোলার এনার্জি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং চালু করা যেতে পারে। গবেষণায় প্রমাণিত—সবুজ পরিবেশ কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক প্রশান্তির জন্যও অপরিহার্য।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনেক সোসাইটিতে “Green Building Concept” চালু হয়েছে। সেখানে আবাসিক ভবনগুলোতে সোলার প্যানেল, পানি পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য রিসাইক্লিং বাধ্যতামূলক। রাজধানী ঢাকায় আমাদের নিউটাউন সোসাইটিও এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা-কোনো সোসাইটি তখনই মানবিক হয়ে ওঠে, যখন দুর্বল, অসুস্থ ও দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ছোটখাটো প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, রক্তদাতা ক্লাব, মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প—এসব থাকলে সদস্যরা একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে—“Primary healthcare at community level reduces 40% pressure from national hospitals.” অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা থাকলে জাতীয় পর্যায়ের চাপ কমে যায়। নিউটাউন সোসাইটিতে এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকলে তা কেবল সদস্যদের জন্য নয়, দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্যও আশীর্বাদ হবে।
ন্যায়, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও নৈতিক ভিত্তি-বাংলাদেশ একটি বহুধর্মী রাষ্ট্র। সোসাইটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নৈতিকতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখা অপরিহার্য। কোরআনে আল্লাহ বলেন—“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা কর; কারণ তা তাকওয়ার কাছাকাছি।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৮)
সুতরাং ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে সোসাইটির নীতি। একইসাথে, ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতার আলোকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অসাম্য দূর করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“তোমরা সবাই অভিভাবক, আর তোমাদের প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জবাবদিহি করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসের আলোকে সোসাইটির নেতৃত্ব দায়িত্বশীলতা ও আমানতদারিত্বের প্রতীক হতে হবে।
শিক্ষা ও জ্ঞান ভিত্তিক নেতৃত্ব- কোরআনের দৃষ্টিতে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত সমান নয়—“বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?” (সূরা যুমার, ৩৯:৯)। এ আয়াত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে সমাজের প্রকৃত চালিকাশক্তি হলো জ্ঞানী মানুষ। একটি সোসাইটির নেতৃত্ব যদি জ্ঞান ও শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তবে সেই সমাজ দূরদর্শিতা, ন্যায়বিচার ও সুশৃঙ্খল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়।
অন্যদিকে, অজ্ঞ-মূর্খ নেতৃত্ব সব সময় ক্ষমতার অপব্যবহার, অব্যবস্থাপনা ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী—যেখানে নেতৃত্ব জ্ঞানহীন ছিল, সেখানে অনাচার ও অরাজকতা বেড়েছে; আর যেখানে নেতৃত্ব জ্ঞাননির্ভর ছিল, সেখানে আলোকিত সমাজ গড়ে উঠেছে।
তাই নিউটাউন সোসাইটি বা যেকোনো আবাসিক সমাজে শিক্ষা ও প্রজ্ঞা-ভিত্তিক নেতৃত্ব অপরিহার্য। এ ধরনের নেতৃত্ব কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং মানবিক, নৈতিক ও ভবিষ্যৎমুখী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। জ্ঞানীরাই জানেন কিভাবে ছোট ছোট সমস্যা বড় সংকটে রূপ নেয়, আর কিভাবে দূরদর্শী পরিকল্পনায় একটি প্রজন্মকে আলোর পথে চালিত করা যায়।
এজন্য আমাদের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা ক্ষমতার নয়, বরং জ্ঞানের আলোয় সমাজকে এগিয়ে নেবে।
প্রযুক্তি ও স্মার্ট ব্যবস্থাপনা- ডিজিটাল যুগে স্মার্ট সোসাইটি অপরিহার্য। সদস্যদের জন্য ই-পেমেন্ট, অনলাইন অভিযোগ সেল, ওয়েবসাইট ও ডিজিটাল ভোটিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনেক আবাসিক সোসাইটি এই মডেল চালু করেছে। ফলে আর্থিক স্বচ্ছতা বেড়েছে, সদস্যদের আস্থা ফিরেছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টি- একটি সমাজের সফলতা কেবল আজকের উন্নয়নে নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য কতটা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে। তাই নিউটাউন সোসাইটিকে শিশু-কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা, খেলাধুলা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় এগিয়ে রাখতে হবে।
আমরা চাই—একটি গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ, নিরাপদ, শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক, পরিবেশ বান্ধব, স্বাস্থ্যসেবামুখী ও মানবিক নিউটাউন সোসাইটি। যেখানে প্রত্যেকে কেবল ভাড়াটিয়া বা জমির মালিক নয়, বরং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে।
আজকের সঠিক সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের সোসাইটির চেহারা। যদি আমরা এখন থেকেই স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা শুরু করি, তবে নিউটাউন সোসাইটি হতে পারে বাংলাদেশের নগরায়ণের এক উজ্জ্বল মডেল।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
১৯৩ বার পড়া হয়েছে