সর্বশেষ

মতামত

সিলেটের সাদাপাথর ইস্যু: পরিবেশ বিতর্কের আড়ালের আসল খেলা

মনজুর এহসান চৌধুরী 
মনজুর এহসান চৌধুরী 

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫ ৬:২১ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে শুরু করে জাফলং, কোম্পানিগঞ্জ, কানাইঘাট — সব জায়গায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ।

সরকারিভাবে যুক্তি দেওয়া হয়েছে “পরিবেশ রক্ষার”, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই বন্ধ হয়ে যাওয়া কোয়ারি হাজার হাজার শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। একসময় যে এলাকা ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভরপুর, সেখানে এখন প্রকৃতির নামে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে অচল কোয়ারির কঙ্কাল আর নিঃস্ব বাজার।

এক কোটি ডলারের বাজার থেকে শূন্যে পতন*
২০০০ সালের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশে ক্রাশড স্টোনের প্রধান উৎস ছিল। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে দেশের অধিকাংশ নির্মাণকাজে সিলেটের পাথর ব্যবহার হতো। তামাবিল সীমান্ত দিয়ে এই পাথর রপ্তানি হতো ভারতীয় রাজ্যগুলোতে – মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায়।
২০১৬ সালের আগে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টন ক্রাশড পাথর ভারতে রপ্তানি করত।পাথর শিল্পে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ১.৫-২ লাখ কর্মসংস্থান ছিল। সরকারি খাতেও রাজস্ব আসত কয়েকশো কোটি টাকা।
কিন্তু ২০১৬ সালে পরিবেশগত ক্ষতির অজুহাতে এই কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

*ভারতের কৌশল: পরিবেশ বনাম অর্থনীতি*
ভারতীয় নর্থ-ইস্ট অঞ্চলের নির্মাণ খাতে পাথরের চাহিদা বহুদিনের। জাফলং ও ভোলাগঞ্জের মতো সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি নদীভাগগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে যে বিপুল পরিমাণ পাথর জমা হতো, তা ভারতের জন্য ছিল বিরাট ক্ষতি—কারণ তারা নিজ ভূখণ্ডে সেই পাথর জমা করতে পারত না। ফলে paradoxical পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ভারতকে তার নিজের পাহাড়ের পাথর বাংলাদেশ থেকে কিনে নিতে হতো।বাংলাদেশে পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ার পর ভারতের সীমানায় গড়ে ওঠে শত শত কোয়ারি। আজ বাংলাদেশের যেসব জায়গায় বিনা মূল্যে পাথর জমা হতো, ভারতের কোয়ারি থেকে সেই পাথর ক্রাশ করে বাংলাদেশেই বছরে ৫০০-৭০০ মিলিয়ন ডলারের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। এই বাজার তৈরীর জন‍্যই ভারত তার মিত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ করেছিল পরিবেশের অজুহাতে।
অর্থাৎ আমরা নিজের দেশ থেকে ফ্রি পাওয়া সম্পদ বন্ধ করে দিয়ে ভারতের কাছে কোটি কোটি ডলার দিয়ে সেই একই পাথর কিনছি।

*সিলেটের বন্যা: পরিবেশ ঝুঁকির উল্টো ইতিহাস*
২০২২ এবং ২০২৪ সালে সিলেট ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। ২০২২ সালের জুনে বৃষ্টিপাত হয় ১৪৫২ মিমি, আর ২০২৪ সালের জুনে তা দাঁড়ায় ২১৫৫ মিমি। পাহাড়ি ঢল সারি ও ডাউকি নদী দিয়ে প্রবেশ করে, নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন হয়নি, ফলে ভয়াবহ বন্যা হয়।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দাবি, যদি নদীগুলোতে নিয়মিত পাথর উত্তোলন হতো, নদীর প্রবাহ সচল থাকত, আর পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার পথ থাকত। নদীর ‘ড্রেনেজ ক্যাপাসিটি’ কমে যাওয়া বন্যার ভয়াবহতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
অতএব, পরিবেশ বাঁচানোর নামে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা উল্টাভাবে অঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে।

*সাদাপাথরের ঝলকানি বনাম বাস্তবতা*
ভোলাগঞ্জ-জাফলঙের সাদা পাথর আজ পর্যটনের প্রতীক। চমৎকার দৃশ্য আর ইনস্টাগ্রাম ছবির জন্য অনেকের কাছে এগুলো এখন “ন্যাচারাল গিফট”। কিন্তু সংকটের আসল মুখ অন্য জায়গায়। কোয়ারিগুলো অচল, শ্রমিকরা বেকার।স্থানীয় বাজার নিঃশেষ, একসময় জমজমাট ব্যবসা এখন নিস্তব্ধ। বাংলাদেশের নির্মাণ খাত আমদানি নির্ভর, কয়লা ও পাথরের মতো বেসিক কাঁচামালে প্রতিবছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে এই একমুখী বাণিজ্য হারের ভার আমাদের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করছে।

*সমকালীন বাস্তবতা (২০২৫)*
বাংলাদেশের স্টোন চিপস আমদানি এখন প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যার বড় অংশ আসে ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে। পরিবেশবান্ধব উত্তোলনের নামে বাংলাদেশে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও কার্যকর হয়নি। স্থানীয় জনগণ অভিযোগ করছে, প্রকৃতির দোহাই দিয়ে “বিদেশি ব্যবসা নিশ্চিত” করাই মূল পরিকল্পনা। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্রমেই আমদানি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, ফলে ছাতকের মতো ঐতিহাসিক শিল্পকারখানা স্থবির হয়ে গেছে।

*শেষ কথা*
সিলেটের সাদাপাথর শুধু একখণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়; এটা বাংলাদেশের হারানো অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক। পরিবেশ সুরক্ষার নামে দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত ভারতকে একতরফা লাভের পথ করে দিয়েছে। যার বিনিময়ে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক বিশাল রপ্তানি খাত, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
আজ সাদা পাথরের ঝলকানি হয়তো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে আছে অর্থলোভী রাজনীতি, বাংলাদেশকে আমদানি-নির্ভর অর্থনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া এবং সীমান্ত-সংলগ্ন মানুষের নিঃশব্দ কান্না।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৬৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন