সর্বশেষ

মতামত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর

আইনশৃঙ্খলার অবনতি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও কালো টাকার চক্র

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫ ২:১৪ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের আগষ্টে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পার হয়েছে। গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে ক্ষমতার রূপান্তর, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা—এই অঙ্গীকারের শেষপ্রান্তে এসে জনমনে যে ভয়, হতাশা ও ক্ষোভ জমেছে, তার মূল কারণ আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি, অপরাধ, লুটপাট, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, পরিবেশ বিপর্যয়, দুর্নীতি ও বিপুল কালো টাকা।

আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয়: অপরাধের গতি বাড়ছে
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি স্পষ্টভাবে গণমাধ্যমের শিরোনামে। খুন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি—প্রতিটি অপরাধের সংখ্যা গত এক দশকের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকায় হত্যাকাণ্ড তিনগুণ, দেশে ১০ মাসে মামলা ১,৪৪,৯৫৫, ছয় মাসে নারী নির্যাতন ১২,৭২৬, ধর্ষণ ৪,১০৫—সাম্প্রতিক পুলিশের তথ্যেই এত বিপর্যয়ের নিশ্চিত ইঙ্গিত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, প্রকাশ্যে অপহরণ-হত্যা, মব ভায়োলেন্স, রাজনৈতিক সংঘাত—সবাইকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে।

লুটপাট, দখল ও চাঁদাবাজি রাজনীতির ছত্রছায়ায়
টিআইবি, গণমাধ্যম আর নাগরিক নেতাদের ভাষ্য; দেশের প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির দাপট। পরিবহন, বাজার, কাঁচামালের ব্যবসা কিংবা সরকারি প্রকল্প থেকে রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট চক্র প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলছে। ব্যবসায়ী লালচাঁদের খুন, সিন্ডিকেটের হাতে ব্যবসায়ী-ঠিকাদার হেনস্তা, অপহরণ, জমি-ভাগাভাগি—পরিচিত অপরাধ চক্র প্রশাসনের চোখের সামনে সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিরোধহীন, বিচারহীন সংস্কৃতিতে চাঁদাবাজি উৎসবের রূপ পেয়েছে।

চাঁদাবাজি, দুর্নীতি—কে দায়ী?
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো, প্রশাসন—সবাই এখনো পুরোনো বিপথে চলেছে।উপদেষ্টার এপিএস-এর-টাকা, দলের নেতাকর্মীদের সরাসরি চাঁদা, প্রশাসন-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট—পত্রিকার শিরোনামে। প্রশাসন, রাজনৈতিক দুর্নীতিবাজ, ব্যবসায়ী—সবাই কালো টাকার সুবিধা নেওয়ার চক্রে; চাঁদাবাজি-লুটপাট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি এক বছর ধরে চলছে।

পরিবেশ ও সম্পদ হরণ—বাঁধভাঙা চুরি আর জবরদখল
পরিবেশগত বিপর্যয়ের রিপোর্টে উঠে এসেছে, নদীর বালি, সাদা পাথর, বন, জলাধার—সবকিছুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাধ‍্যমে প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় দিনের আলোয় চুরি হচ্ছে। পরিবেশ আইন অকার্যকর; শিল্প-কারখানার বর্জ্যের ‘নোংরা’ দৌরাত্ম্য প্রকৃতিকে বিষিয়ে তুলছে। বন উজাড়, প্রকৃতির মৃত্যু, খাল-বিল দখলে পরিবেশ সংকট চরমে। প্রশাসনিক দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার—কোথাও দৃশ‍্যত শাস্তি নেই বলে চুরি অব্যাহত।

দুর্নীতির বেড়াজাল ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়
অর্থনৈতিক সামষ্টিক চিত্রে উন্নয়নের আলোকরশ্মি থাকলেও, সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে কালো টাকার মহামারী ও অর্থ পাচার। সরকারি হিসাবে $২৩,৪০০ কোটি ডলার পাচার ২০০৯-২০২৩; বছরে প্রায় ১,৮০,০০০ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার সুবিধা রেখে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার আইন রেখে দিয়েছে। ফলে অবৈধ টাকা ব্যাংকে ঢুকতে পারে, উৎস জানা হয় না। দেশে জালিয়াতি, ঘুষ, সিন্ডিকেট, অবৈধ ব্যবসা, ফ্ল্যাট-ভবন খাতে বিশাল পুঁজি খাটানো—সবই ‘কালো টাকা’র অসৎ প্রবাহ সোচ্চারে চলছে।

সরকারের ব্যর্থতা—নোট বাতিল না করে কালো টাকার পুঁজি
সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত, ৫০০ ও ১,০০০ টাকার পুরাতন নোট বাতিল হয়নি। নতুন নোট ছাপা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই। রাজনৈতিক কর্মকাঠামো, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় এই কালো টাকা বাঁধাহীনভাবে পাচার হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও ব্যবহার হচ্ছে—চাঁদাবাজি, দখল, কমিশন, ঘুষ—সব সমস্যার মূলও এখানেই. নাগরিক তো বলেই উঠছেন—“সরকার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে চাঁদাবাজির, দুর্নীতির, টাকার অবৈধ ব্যবহারের”।

অর্থ পাচারের উন্মুক্ত রুট—ডলার, ইউরো, পাউন্ড বাইরে
বিষয়টি আরও ভয়াবহ—ডলার, পাউন্ড, ইউরো হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হুন্ডি, অনলাইন ট্রান্সফার, বিদেশি বিনিয়োগে দেশ ছাড়ছে। দেশের রিজার্ভ কমছে, বিনিয়োগ সূচকে নেতিবাচক পরিবর্তন, কর্মসংস্থানে নতুন ক্রান্তিকাল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও মূলধন পাচার দিয়ে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের হুমকি সমাজে কঠিন হয়ে উঠেছে।

প্রতিরোধ নেই—আইন, প্রশাসন, নীতিকাঠামোর দুর্বলতা
সরকারি উদ্যোগ, আইন, দুদক, বিআইএফইউ—সব প্রতিষ্ঠানের নজরদারি থাকলেও, কার্যকর পদক্ষেপ নেই; বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, বড় নোট বাতিল না করা, সম্পদের সত্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়—সবই দুর্নীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। উপদেষ্টা ও সচিবদের সম্পদের বিবরণ দেবার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক ক্যাডার, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা—সবাই দুর্নীতিকে নির্মূলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা—নির্বাচন অনিশ্চয়তার চাপে
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অশান্তি ও অনিশ্চয়তা ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন, প্রধান রাজনৈতিক দল ও বিরোধী নেতৃত্ব—সবার ভেতরেই গভীর বিভক্তি, আস্থার সংকট। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে মতদ্বন্দ্ব, আন্দোলন, বিক্ষোভ, অস্থিরতা—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন দূরবর্তী।

সার্বিক সংকট—যে প্রশ্নের উত্তর নেই
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি, চাঁদাবাজি-দখলবাজি, সচল দুর্নীতি, পরিবেশ-সম্পদের চুরি, কালো টাকা ও পাচার—এসব কিছুর মিলিত ধাক্কায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর সংকটে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্বস্তি, পরিবেশ সুরক্ষা—সবই প্রায় ‘রানিং ক্রাইসিস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহি, সংস্কার, আইনের শাসন, দুর্নীতির কঠোর দমন ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নতির কোনো গ্যারান্টি নেই।

বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
এক বছরের সমষ্টিগত সংবাদ-প্রতিবেদন বিশ্লেষণে স্পষ্ট—আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয়, লুটপাট, দখল, চাঁদাবাজি, পরিবেশ ও সম্পদ লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং কালো টাকা; এগুলোই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বৃহৎ সংকট।
সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতায় দিন দিন সংকট আরও গভীর হচ্ছ।এক্ষেত্রে যদি দ্রুত, সিদ্ধান্তমূলক, স্বচ্ছ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা শুধু সরকারিভাবে ঘোষিত লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে দেশের জন-অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ বিকল হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অপরাধ আর অর্থপাচারের যন্ত্রণায়।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট 

১৯৯ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন