গাজীপুরে অপরাধের রুটম্যাপ: টঙ্গী থেকে চান্দনা আতঙ্কের রাজত্ব

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫ ৫:৫৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গাজীপুর মহানগরীর শুরুটাই যেন এখন অপরাধের ঘাঁটি।
টঙ্গী স্টেশন রোড, উড়ালসড়ক, চান্দনা চৌরাস্তা, জয়দেবপুর ও কোনাবাড়ী—এই পাঁচটি এলাকা সম্প্রতি চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে পরিণত হয়েছে আতঙ্কের নাম। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, এসব এলাকায় সন্ধ্যার পর চলাফেরা করাই হয়ে উঠেছে দুঃসাহসিক কাজ।
মহানগর পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই গাজীপুর মহানগরীর আটটি থানায় ৪৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে সদর থানায়—১১টি। ২০২৪ সালে এই থানায় হত্যার মামলা ছিল ৮টি।
টঙ্গী থেকে চান্দনা: অপরাধের সেক্টরভিত্তিক বিস্তার
গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন থানা এলাকায় চলতি বছর (জানুয়ারি-জুলাই) হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান হলো:
টঙ্গী পূর্ব: ৮টি
টঙ্গী পশ্চিম: ৬টি
কোনাবাড়ী: ৭টি
কাশিমপুর: ৪টি
গাছা: ৫টি
পুবাইল: ৪টি
বাসন: ৫টি
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরে হত্যা, চুরি, ছিনতাই এবং ডাকাতির ঘটনা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে চাঞ্চল্য
গত কয়েক মাসে একের পর এক হত্যাকাণ্ড জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
১৬ মে: টঙ্গী ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান প্রাইভেট কারচালক রনজু খাঁ।
১৭ মে: একই ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে নিহত হন যুবক মো. রনজু (৩২)।
১০ জুলাই: টঙ্গীর সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে কলেজশিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান খুন হন।
৭ আগস্ট: চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে।
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নগরবাসী
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের টহল ও নজরদারি বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়। ভোগড়া এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, “এখন দিনের বেলাতেও অনেকে একা চলাফেরা করতে ভয় পান। রাতের বেলা প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে যাই না।”
অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের কারণ
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান জানান, “৫ আগস্টের পর বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এতে বহু মানুষ বেকার হয়েছেন। কর্মসংস্থান না থাকলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। এছাড়া, আগের সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশ গাজীপুরকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাও করছে।”
অপরদিকে, সুজনের গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির মনে করেন, অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে—শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকদের বেকারত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. জাহিদুল হাসান বলেন, “সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পর নগরের জনাকীর্ণ এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোটরসাইকেল তল্লাশিও চালানো হচ্ছে।”
গাজীপুর মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এখন কার্যত অপরাধীদের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগ ও নজরদারির পরও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা দূর হচ্ছে না। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, কেবল টহল বাড়ানোই নয়, অপরাধের পেছনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি।
১২১ বার পড়া হয়েছে