সর্বশেষ

মতামত

'পি আর' পদ্ধতি: বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা, সংকট ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা

শৈবাল আদিত্য
শৈবাল আদিত্য

শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫ ৬:৪৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। দেশের কিছু রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার (First Past the Post - FPTP) বদলে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা 'পি আর' (Proportional Representation) পদ্ধতির দাবি তুলেছে। এই দাবি তুলেছে বাম দলগুলোর একটি বৃহৎ অংশ, কিছু জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থী দলও।

অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি— যাদের অভিযোগ, দেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশই নেই— তারা 'পি আর' পদ্ধতির পক্ষে নয়। তাদের যুক্তি, এতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সমস্যা একদিক দিয়ে কমলেও, অপরদিকে নীতিহীন ছোট ছোট দল বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীভিত্তিক স্বার্থান্ধ রাজনীতির ঝুঁকি বাড়তে পারে।

এতদসত্ত্বেও প্রশ্নটা উঠে— বাংলাদেশের জন্য কি আদৌ 'পি আর' পদ্ধতি কার্যকর হবে? এটি কি গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবে, না কি পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে?

'পি আর' পদ্ধতি কী?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা 'পি আর' পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। যেমন, কোনো দল যদি ৩০% ভোট পায়, তাদের সংসদেও ৩০% আসন বরাদ্দ হবে।

'পি আর' পদ্ধতিরও ধরন রয়েছে৷ সেগুলো হলো— ১. ক্লোজড লিস্ট পিআর: যেখানে দল প্রার্থী তালিকা দেয়, ভোটার কেবল দলকে ভোট দেন। ২. ওপেন লিস্ট পিআর: যে পদ্ধতিতে ভোটার প্রার্থী নির্বাচনেও মত দিতে পারেন। এবং সবশেষ হলো ৩. মিক্সড পদ্ধতি: যেখানে এক অংশ FPTP, অন্য অংশ 'পি আর'।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'পি আর' পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি:
১. ভোটের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা:
'পি আর' পদ্ধতিতে ভোটের মূল্যায়ন বেশি হয়। একক আধিপত্যের প্রবণতা কমে যায়।

২. ছোট দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত:
বর্তমানে আদিবাসী, নারী নেতৃত্বের দল, পরিবেশবাদী প্ল্যাটফর্ম—এরা ভোট পেলেও সংসদে যেতে পারে না। 'পি আর' পদ্ধতিতে তাদের সুযোগ বাড়বে।

৩. সহিংসতা ও নির্বাচনী অনিয়ম হ্রাস:
প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব সমান হলে ভোট কেন্দ্র দখল বা সহিংসতার প্রবণতা কমে।

'পি আর' পদ্ধতির ঝুঁকি ও আপত্তি:
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নের আশঙ্কা:
ছোট ছোট দল জোটে না আসায় সরকার গঠন জটিল হয়ে পড়ে। বারবার সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে।

২. ব্যবসায়ী বা স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর দখল:
ধনী গোষ্ঠী বা কর্পোরেট শক্তি সহজে দল কিনে সংসদে ঢুকে যেতে পারে।

৩. আইনগত জটিলতা:
বাংলাদেশের সংবিধানে FPTP পদ্ধতি রয়েছে। 'পি আর' চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা:
বিশ্বে প্রায় ৯০টির বেশি দেশে 'পি আর' ব্যবহৃত হয়। তবে সব দেশে এর ফলাফল একরকম নয়।

সফল উদাহরণ হচ্ছে, ১. জার্মানি: সেখানে মিক্সড পদ্ধতি। এতে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়। ২. স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক): এসব দেশগুলোতে 'পি আর পদ্ধতি' অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়সংগত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ৩. নিউজিল্যান্ড: যেখানে FPTP থেকে 'পি আর'-এ গিয়েছে। এতে নির্বাচন ঘিরে সংঘাত কমেছে।

এই পদ্ধতির ব্যর্থ উদাহরণও রয়েছে৷ সেগুলো হলো— ১. ইসরায়েল: যেখানে পুরোপুরি 'পি আর' পদ্ধতির কারণে বারবার সরকার পতন ঘটেছে। ২. ইতালি (১৯৪৫-৯০ দশক): সেখানে প্রায় প্রতি বছর সরকার পরিবর্তন হয়েছে। স্থিতিশীলতা ছিল না।

বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতামত:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরেন্ট লেইপহার্ট বলেন,  "পি আর পদ্ধতি আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়। পক্ষান্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন অনেক সময় বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়।"

অন্যদিকে জিওভানি সার্তোরি বলেছেন,  "পি আর গণতন্ত্রের ঘাটতি পূরণ করতে পারে, তবে রাজনৈতিক খণ্ডিতকরণ ও নীতিগত অচলাবস্থা তৈরির ঝুঁকিও বাড়ায়।"

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয় ও সুপারিশ:
১. পূর্ণাঙ্গ 'পি আর' নয়, মিশ্র পদ্ধতির চিন্তা করা যেতে পারে।
যেমন— ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০০টি থাকুক FPTP-তে, বাকিগুলো হোক 'পি আর'-এ। এতে ভারসাম্য আসবে।

২. স্বচ্ছ দল নিবন্ধন ও ফান্ডিং নিয়ম চালু করা জরুরি।
না হলে 'পি আর' পদ্ধতিতে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী রাজনৈতিক দল বানিয়ে বাজার দখল করতে পারে।

৩. জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা প্রয়োজন।
নির্বাচনী পদ্ধতি শুধু এক বা দুই দল ঠিক করে দিলে হবে না। সব দলের অংশগ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা প্রয়োজন।

পরিশেষে, 'পি আর' পদ্ধতি নিঃসন্দেহে ভোটের ন্যায্যতা ও বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়ক। তবে এটি কোনো ম্যাজিক সমাধান নয়। বাস্তবতা হচ্ছে— নির্বাচনী পদ্ধতির চেয়েও বড় সমস্যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চার দুর্বলতা।
একটা সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না করে শুধু পদ্ধতি বদলালে সুফল আসবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

তবুও বর্তমান বৈচিত্র্যময় রাজনীতিতে আলোচনা শুরু হওয়া ইতিবাচক। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিণত হয়ে ওঠার জন্য এমন বিতর্কই সময়ের দাবি।

(লেখক : কবি ও সাংবাদিক, সিনিয়র সাব-এডিটর, দৈনিক ইত্তেফাক)

১১৯ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন