কিশোর কুমার : ভাঙা চাঁদের আলোয় আনন্দের সুর, বিষাদের রেশ

সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫ ৭:৫২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
এই দিনে জন্মেছিলেন এক বিস্ময়! যিনি ছিলেন সংগীতের মাতালের মতো, আবার নিঃসঙ্গ ব্যাকরণহীন এক কবিও বটে। এক বহুমাত্রিক শিল্পী, যিনি গানের ভাষায় হৃদয়ের আলেখ্য এঁকেছেন, আর অভিনয়ের পরতে পরতে সাজিয়ে রেখেছেন হাসি ও বিষাদের ধ্রুবপদ।
কিশোর কুমার— উপমহাদেশের সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। যার কণ্ঠে ছিল প্রেমিকের আবেদন, উদাসীর কান্না, সময়ের বিদ্রুপ; আবার বোহেমিয়ান শিল্পীর নিজস্ব ছাপ।
১৯২৯ সালের এই দিনে মধ্যপ্রদেশের খন্দোয়ায় জন্ম নিয়েছিলেন অভিষেক গাঙ্গুলী, যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন কিশোর কুমার। বড় ভাই অশোক কুমারের হাত ধরে বলিউডে পা রাখলেও, কিশোর কুমার নিজের পথ নিজেই তৈরি করেন। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী ও এক বিস্ময়কর কৌতুকপ্রেমী। কিন্তু তারও আগে তিনি ছিলেন এক 'প্যাথেটিক লোনার'— একাকীত্বে মগ্ন এক গায়ক।
কোনো গুরুর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক তালিম না নিয়েও তিনি হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের একজন। শুধু জনপ্রিয়ই নন, গায়ক হিসেবে কিশোর ছিলেন এক চরম আত্মানুসন্ধানী শিল্পী।
হিন্দি গানের ভুবনে তার গাওয়া “রূপ তেরা মস্তানা”, “মেরে ন্যায়ন সাওন ভাদো”, “জিন্দেগী এক সফর হ্যায় সুহানা”, “হঁসি ওহ, গান্ধি ওহ, মজনু ওহ”—এসব শুধু গান নয়, সময়ের দলিল। আর যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, “কোই লটা দে মেরে বিগড়ে হুয়ে দিন”—তখন যেন বেজে ওঠে নিজস্ব জীবনের বিষাদসুর।
তবে বাংলা গানেও কিশোর কুমারের অবদান অনন্য। বিশেষত তার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত— “আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যারে…”, কিংবা আধুনিক গান—
“একদিন চলে যাবে আমিও চলে যাবো…”, “তোমায় দেখা নাই বহুদিন…” অথবা “দূর অন্তরালে ভালোবাসা গোপন রেখো না”— এসব গান বাঙালির রক্তে মিশে আছে। বাংলা গানে কিশোরের কণ্ঠে ছিল এক অনাবিল কোমলতা— যেখানে অতীতের সুরমণ্ডলে ডুবে থাকা শ্রোতা খুঁজে পায় নিজের হারানো দিন।
অভিনয়েও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। হিন্দিতে যেমন ‘চলতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পড়োশন’— তেমনি বাংলা ছবিতেও তার অভিনয় ছিল সমান প্রাণবন্ত। বিশেষ করে ‘লুকোচুরি’, ‘মিস মালিনী’, ‘বেগুনী রাতের কাব্য’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘আনন্দ আশ্রম’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার সহজাত অভিনয়দক্ষতা দর্শকের হৃদয়ে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
তার জীবন ছিল দ্বন্দ্ব ও দোলাচলের এক মিশ্রপট। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, আত্মভোলা, কখনো বিদ্রোহী, কখনো নির্জনবাসী।
চারবার বিয়ে করেছেন— রুমা গুহঠাকুরতা থেকে শুরু করে মধুবালা, যোগিতা বালি এবং লীনা চন্দাভরকর—এই চারটি সম্পর্কই ছিল ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন পরিণতির।
বিশেষ করে মধুবালার সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বিবাহ উপমহাদেশীয় গীতিকাব্যের এক করুণ অধ্যায়।
মধুবালার মৃত্যু যেন কিশোর কুমারের হৃদয় থেকে শেষ রঙটুকুও শুষে নেয়। এর পর তার গানে বারবার ফিরে আসে বেদনা, একাকীত্ব, শূন্যতা।
সত্তরের দশকে যখন বলিউডে সংগীত ধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে, তখন কিশোর কুমার হয়ে ওঠেন এক ‘সংগীতবিপ্লবী’। আর ডুয়েটে লতা, আশা, রফি ও বহু কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে যুগলবন্দি তার কণ্ঠেই পেয়েছে এক নতুন সঙ্গত।
পুরস্কারের দিক থেকেও কিশোর ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আটবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সেরা পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। ভারতীয় সিনেমা জগত নানা কণ্ঠে যখন সুর খুঁজে ফিরত, তখন কিশোরের কণ্ঠেই তারা পেতো পথের দিশা।
তবু কিশোর ছিলেন পুরস্কারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু— তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের বুকের ভেতরে এক গোপন বেহালা, যা আজও বাজে।
জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে তিনি হয়ে পড়েন আত্মগোপনে আগ্রহী, ফোনের লাইন কেটে রাখতেন, মিডিয়া এড়িয়ে চলতেন, নিজের মতো একটা চুপচাপ ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন।
১৩ অক্টোবর ১৯৮৭, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আচমকা তার মৃত্যুর পর যেন সংগীতের আকাশে নেমে এসেছিল গভীর স্তব্ধতা।
কিশোর কুমার শুধুমাত্র একজন শিল্পী ছিলেন না— তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক সত্তা, এক অস্থির হৃদয়ের অর্কেস্ট্রা। তার গানে যে প্রেম, যে হাহাকার, যে মাতলামি, তা কেবল রেকর্ডে নয়— প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ের ঘরে বসত করে চলেছে।
আজ তার জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করি— “একদিন চলে যাবে আমিও চলে যাবো…”।
কিন্তু কিশোর কুমার? তিনি যাবেন না। তিনি থাকবেন…
ভেসে থাকা কোনো গান হয়ে। মৃদু লয়ে বাজতে থাকা কোনো একাকী দুপুরে।
১৩৭ বার পড়া হয়েছে