সর্বশেষ

জাতীয়

৩৫ জুলাই সহিংসতার ছায়ায় জনগণ বনাম রাষ্ট্রের সন্ধিক্ষণ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫ ৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে চরম, রক্তাক্ত ও সংকটময় দিন। ছাত্র-জনতার অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ যে শক্তি নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটি আজ হাজারো প্রাণ, অনিশ্চিত রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত এবং সর্বাত্মক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পাল্টা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিস্ফোরিত হয়েছে।

এই দিনে ঢাকার রাজপথ ও দেশের প্রতিটি জনপথে সহিংসতা, হতাহতের মিছিল, সরকারের উদ্বেগ, রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, দেশত্যাগ ও সামাজিক বিপর্যয় একসঙ্গে ঘটেছে—আরো ঘটে চলেছে।


ভোর থেকেই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক: দোকানপাট, অফিস, ব্যাংক, আদালত, স্কুল—সব বন্ধ। রাজধানীর প্রতিটি মোড়, বিভাগীয় ও জেলা শহরে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা অবস্থান নেয়; ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের অবস্থান কর্মসূচি, অধ্যক্ষ নানকের কড়া ভাষায় প্রতিরোধের ডাক—“ধৈর্যের শেষ সীমা, কেউ ঘরে বসে থাকবেন না, সন্ত্রাস রুখে দাঁড়ান।”

একই সাথে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ‘গণবিদ্রোহের’ পক্ষে দেশব্যাপী চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দেন। সবাইকে ‘রাজপথে থেকেই শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করার আহ্বান জানায়। সারা দিন দেশের সর্বত্র মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল, পাল্টা পাল্টি স্লোগানে উত্তাল থাকে জনপদ।


সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বিশেষ বৈঠক—সেখানে সেনাবাহিনীর “গুলি না করার”, “মানবঢাল” হয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সিদ্ধান্ত আবারও পুনর্ব্যক্ত হয়। ঢাকা শহর, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জসহ অন্তত ৩০ জেলার থানায়, সরকারি স্থাপনায়, দলীয় কার্যালয়ে হামলা, আগুন, ভাঙচুর, অস্ত্রাগার লুটের ঘটনা ঘটে—বিশেষ করে চট্টগ্রামে কমপক্ষে ৫০০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ১২ হাজারের বেশি গুলি, প্রায় ৬ লাখ কার্তুজ লুট হয়; সিরাজগঞ্জ এনায়েতপুর থানায় ১৩ পুলিশ সদস্য, ঢাকার উত্তরা ও জাত্রাবাড়ীতে ৫-৮, ইলিয়টগঞ্জ কুমিল্লায় ১, সারাদেশে মোট ১৫ জন পুলিশের নিহত হওয়ার ঘটনা নিশ্চিত।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—কয়েকটি থানায় পুলিশ আত্মসমর্পণ, কোনো কোনো স্থানে পালিয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের হতাহতের সংখ্যা সরকারিভাবে ৯০-৯৪ বলা হলেও—ভিন্ন রিপোর্ট ও হাসপাতালে হিসাব বলছে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি, আহত ও গ্রেফতার অন্তত ১,২০০। হাসপাতালে স্বজনহীন মৃতদেহ, রক্তাক্ত মিছিল, কান্নার রোল।


সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, গার্মেন্টস, আদালত সম্পূর্ণ বন্ধ, শিল্পাঞ্চল অচল। সরকার বিকেল ৬টা থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ ঘোষণা, ৫–৭ আগস্ট সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে; সুপ্রিম কোর্টসহ নিম্নআদালত বন্ধ, সংবাদ প্রচারে প্রশাসনিক বাধা, সাংবাদিক হত্যার মিছিল (৬ জন নিহত, ২৫০-এর বেশি আহত/গ্রেফতার)। মোবাইল ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, সব কিছু বন্ধ — বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে সন্ধ্যার পর ঢাকা ও বড় শহরগুলো ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।


রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার চাপে সুউচ্চ প্রশাসনে আস্থা হারিয়ে ১৭ জন মন্ত্রী–এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ী পরিবারসহ গোপনে দেশত্যাগ করেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তাদের গন্তব্য সিঙ্গাপুর, লন্ডন, দুবাই, মালয়েশিয়া। তাদের বেশিরভাগই অতীতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্যের ভাষণ দিলেও, সংকটে নিজেরা গোপনে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন—এ খবর দেশের মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে।


এদিন বিকেলে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী আলী আরাফাত জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন—“সরকার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী, কিন্তু যারা এখন নাশকতা ও সহিংসতায় জড়িত—তাদের কড়া হাতে দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত। যারা প্রকৃত ছাত্র, তাদের জন্য সহানুভূতি—কিন্তু আজকের সহিংসতায় অংশগ্রহণকারী ‘ছাত্র’ নয়, বরং সন্ত্রাসী।”


শেখ হাসিনা এদিন সরাসরি বিবৃতি দেন—“আজকে যে নাশকতা চলছে, যারা সরকারি সম্পদ, সাধারণ মানুষের জানমাল ধ্বংস করছে, তারা কেউ ছাত্র নয়, তারা সন্ত্রাসী। দেশের সবাইকে বলছি—এদের শক্ত হাতে দমন করুন।” সেই ঘোষণার পাশাপাশি সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সর্বত্র রাজপথে অবস্থান নেন—কারফিউ পরিস্থিতিতেও প্রশাসনের নীরব সমর্থনে স্থানীয় পর্যায়ে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে।


হাইকোর্টে ‘পুলিশ গুলি না করার’ রিট খারিজ হয়; আদালত ঘোষণা দেয়, জরুরি পরিস্থিতি, দাঙ্গা, নাশকতার সময়ে পুলিশ আইন অনুযায়ী বলপ্রয়োগ (প্রয়োজনবোধে গুলি) করতে পারে—এরপর পুলিশ, প্রশাসন আরও কঠোরতার সঙ্গে পরিস্থিতি দমন শুরু করে।


চারদিকের আন্দোলন গ্রাম-শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে: চট্টগ্রামের ৮ থানা, ১২ পুলিশ বক্স, বগুড়া, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ—সবখানেই পুলিশি উপস্থিতি, সেনাবাহিনীর মানবঢাল, সাধারণ মানুষের থমথমে জীবন। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, মন্দিরে হামলার আশঙ্কা তৈরি হলে অনেকেই সীমান্তের দিকে আশ্রয়ের খোঁজ করেন, কোথাও কোথাও ছোট আকারের শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়।


আন্দোলনকারীদের পরবর্তীকালের ঘোষণা, ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) ‘March to Dhaka’ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিটি জেলা-শহর-ক্যাম্পাস থেকে শত সহস্র মানুষের ঢাকামুখী পদযাত্রার প্রস্তুতি চলে। লিফলেটে, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ভাইরাল ‘ঢাকায় চলো’ হয়ে ওঠে উত্তাল—সরকার, সেনা, পুলিশ টিকতে পারবে নাকি গণজোয়ারে ভেসে যাবে, ইতিহাসের মোড় তখনও খোলা ছিল।


রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জটিলতর হয়ে ওঠে—জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলপ্রয়োগ এবং মিডিয়া-নিষেধাজ্ঞার কড়া সমালোচনা করে; বাংলাদেশের সংবিধান, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থা নিয়ে বারবার নতুন তদন্ত ও মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব বিবেচনায় আসে।


কিন্তু দিনের শেষে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে ৩৫ জুলাই ২০২৪-এর ভয়াবহতা—৯০-৯৪ নাগরিক প্রাণহানি, ১৫’র ওপর পুলিশ নিহত, শতাধিক গ্রেফতার-আহত, হাজারখানেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট, বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট বন্ধ, রাজধানীসহ শহর-গ্রাম আতঙ্কে ঘেরা জীবন্ত নরক এবং রাজনীতির নামে শ্রেষ্ঠ ত্যাগের কান্নায় মোড়ানো—দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অস্থির, বিভক্ত ও কঠিন দিন হিসেবে অবিস্মরণীয় চিহ্ন রেখে গেল।


এই দিনের পরই গোটা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নতুন পথে, নতুন বিভক্তিতে, নতুন স্বপ্ন ও সংগ্রামে মোড় নেয়—যার সমাপ্তি তখনো অজানা, কিন্তু ইতিহাস জানিয়ে দেয়—এটি ছিল ‘একটি যুগোদ্ধারণ’ দিনের খোলচুরির গল্প।

১২৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন