মতামত

আগুনে পোড়া দেশ: রাষ্ট্র কি শেখে তার ভুল থেকে?

শৈবাল আদিত্য
শৈবাল আদিত্য

শনিবার, ২ আগস্ট, ২০২৫ ৫:৫০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যেন এক অনিবার্য চিত্র হয়ে উঠেছে। শুধু গার্মেন্টস কারখানা, রাসায়নিক গুদাম বা মার্কেট নয়— এবার অগ্নিকাণ্ড পৌঁছে গেছে শিক্ষাঙ্গনেও।

সাম্প্রতিক মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি সে কথাই আবার মনে করিয়ে দিল। প্রশ্ন হচ্ছে—এত বড় বড় দুর্ঘটনা কেন প্রতিনিয়ত ঘটছে? এগুলোর প্রতিরোধ কি আদৌ সম্ভব নয়? রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কোথায় ঘাটতি, আর করণীয়ই বা কী?

সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডি: মাইলস্টোন স্কুল
চলতি মাসের ২১ তারিখ ঢাকার উত্তরা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশেই বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। দুর্ঘটনার সময় স্কুল চলমান থাকায় বহু শিক্ষার্থী অগ্নিদগ্ধ হয়। প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে সরকারিভাবে জানানৈ হয়েছে এ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের, মুমূর্ষ অবস্থায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরো ৬৫ জন৷ স্মরণকালের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। একসঙ্গে এত শিক্ষার্থীর মৃত্যু বা আহত হওয়া এদেশের ইতিহাসে বিরল।

এই ঘটনা আবারও সামনে এনেছে রাষ্ট্রের জরুরি সেবা, শহর পরিকল্পনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতির বাস্তব চিত্র।

বাংলাদেশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা
১. সীতাকুণ্ড বিএম কনটেইনার ডিপো বিস্ফোরণ (৪ জুন ২০২২):
৫১ জন নিহত, ২০০ জনের অধিক আহত হন। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের মতে, ডিপোতে উচ্চমাত্রার হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সংরক্ষিত ছিল, যা কর্তৃপক্ষ গোপন রেখেছিল।
(সূত্র: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, ২০২২)

২. চকবাজার অগ্নিকাণ্ড (২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯):
৭১ জন নিহত হন, আহত হয় শতাধিক। ঘটনার মূল কারণ ছিল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, যেখানে কোনো অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
(সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস)

৩. তাজরীন ফ্যাশনস আগুন (২৪ নভেম্বর ২০১২):
১১২ জন শ্রমিক নিহত হন, ১৫০ জনের বেশি আহত। জরুরি নির্গমন পথ বন্ধ ছিল। কারখানার মালিকপক্ষ পরে দণ্ডিত হয় না।
(সূত্র: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন)

এছাড়াও নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার ও ধানমন্ডির মার্কেট অগ্নিকাণ্ড (বিভিন্ন সময়):
ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি, নিরাপত্তা ঘাটতির প্রশ্ন।

এই সব ঘটনা এক জায়গায় মিলিত হয় একটি প্রশ্নে—কেন রাষ্ট্র আগুন প্রতিরোধে ব্যর্থ?

পরিসংখ্যান: আগুনের ভয়াবহতা কতটা?
ফায়ার সার্ভিসের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২৩):
▪ বছরজুড়ে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা: ২৪,১০২টি
▪ প্রাণহানি: ১২৭ জন
▪ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ: আনুমানিক ৪৪০ কোটি টাকা
▪ আগুন লাগার প্রধান কারণ: বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট (৬৩%), গ্যাস লিকেজ (১৬%), দাহ্য পদার্থের অসতর্ক সংরক্ষণ (১২%)

ঢাকা মহানগরীতে প্রতি মাসে গড়ে ২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
(সূত্র: ডিএনসিসি, ডিএসসিসি ফায়ার বিভাগের সমন্বিত তথ্য, ২০২3)

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ঘাটতি: পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ
১. অকার্যকর আইন প্রয়োগ:
২০০৬ সালে প্রণীত 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC)' এবং 'ফায়ার প্রিভেনশন অ্যাক্ট, ২০০৩' অনুসারে প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবনে নির্দিষ্ট অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ ভবনই এ আইন মানে না।
অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও ৬০% এর বেশি মার্কেট ও কারখানা চালু রয়েছে (সূত্র: রাজউক, ২০২২)।

২. দুর্বল সমন্বয় ও মনিটরিং:
সিটি করপোরেশন, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, শিল্প মন্ত্রণালয়—সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দায়িত্ব জটিলতা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে এক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পেলেই কার্যত অন্য নিয়ম ভঙ্গ করা সম্ভব হয়।

৩. দুর্বল প্রস্তুতি ও ফায়ার সার্ভিসের সীমাবদ্ধতা:
দেশজুড়ে ৪৯১টি ফায়ার স্টেশনের মধ্যে অনেকগুলোয় পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। ঢাকায় মাত্র দুটি ল্যাডার ট্রাক রয়েছে, যা ১০ তলার ওপরে কার্যকর নয়।
(সূত্র: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩)

করণীয়: সুপারিশসমূহ
১. জাতীয় অগ্নি-নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন:
সুনির্দিষ্ট টাইমলাইনসহ অগ্নিকাণ্ড রোধে একটি জাতীয় কৌশল দরকার, যা শুধু আইন নয়, বরং বাস্তবায়নকেন্দ্রিক।

২. ফায়ার অডিট বাধ্যতামূলক ও স্বচ্ছ:
বাণিজ্যিক ভবন, কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত একবার স্বাধীন ফায়ার অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

৩. পুরান ঢাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পুনঃবিন্যাস:
চকবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর দাহ্য পদার্থের গুদাম দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে নির্ধারিত শিল্প অঞ্চলে।

৪. ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন:
হাইড্রোলিক ল্যাডার, হিট-রেজিস্ট্যান্ট পোশাক, হেলিকপ্টার ইউনিট, ড্রোন-সাপোর্ট সিস্টেম এবং কেমিক্যাল রেসপন্স ইউনিট চালু করা জরুরি।

৫. নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো:
স্কুল-কলেজে 'ফায়ার ড্রিল' বাধ্যতামূলক করা হোক। জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালাতে হবে টিভি, রেডিও, অনলাইন ও মোবাইল প্ল্যাটফর্মে।

৬. ভবন অনুমোদনে জিরো টলারেন্স:
রাজউক, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ভবন নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে ফায়ার সেফটি অডিট পাশ করাতে হবে।

পরিশেষে, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড কেবল সংখ্যা নয়—তা একেকটি জীবন, একেকটি পরিবারের ইতিহাস। বারবার যখন রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় আগুনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে, তখন শুধু অব্যবস্থাপনাই নয়, মানবতাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, রিপোর্ট জমা পড়ে, সংবাদমাধ্যমে কিছুদিন তোলপাড় হয়, তারপর ধুলো জমে আরেকটি রিপোর্টের ওপর। উন্নয়নের আলোয় ঝলমলে শহর যদি ভিতরে ভিতরে এমন বিপজ্জনক থাকে, তবে সে উন্নয়ন বিষফোঁড়ার মতো। রাষ্ট্রকে চাইলে সক্ষম করা যায়— ইচ্ছা, জবাবদিহিতা আর বিজ্ঞাননির্ভর পরিকল্পনার মাধ্যমে।

এই বার্তা রাষ্ট্রের কান পর্যন্ত পৌঁছাক, যেন আগুনের গল্প আর না লিখতে হয়— কবিতায়, সংবাদে কিংবা কবরফলকে।
(লেখক : কবি ও সাংবাদিক, সিনিয়র সাব-এডিটর, ইত্তেফাক অনলাইন)

১২৭ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন