মতামত

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫ ৬:১০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, সেটা কেবল একটি দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়—বরং এটি ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের একচ্ছত্র দখল, স্বৈরশাসন এবং জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। শত শত মানুষের ত্যাগ আর হাজারো শহীদের রক্তে আজ এই প্রশ্ন জাগে: পতন হলেও কি আমরা শিক্ষাগ্রহণ করেছি?

স্বৈরাচার পতনের নেপথ্যে কারা?

গণঅভ্যুত্থানকে কেউ কেউ জামাত-বিএনপি কিংবা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে থাকেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের মাধ্যমে—কোটা সংস্কার থেকে শুরু হওয়া ক্ষোভ ধীরে ধীরে সর্বস্তরের জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজপথে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ যখন একাট্টা হল, তখন তাদের পরিচয় ছিল না জামাত, বাম, বা ডান কোনো তকমা দিয়ে। তারা ছিল নিপীড়িত নাগরিক—যারা কথা বললে মামলা খায়, পোস্ট দিলে গুম হয়, ভোট দিতে গেলে ভোট পায় না।

আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসন: এক স্বৈরতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি

আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪—তিনটি নির্বাচনই করেছে ভোটারবিহীন বা অবৈধ পন্থায়। হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয় ব্যবহার এদের শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এই দল চেয়েছে সমালোচনা বন্ধ করতে, বিদেশে বসেও কেউ যেন সমালোচনায় মুখ না খোলে। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বদল, মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ, বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ—সবই করেছে তারা “উন্নয়নের” মোড়কে।


বিদেশি প্রবাসী নাগরিকরাও কি দায়মুক্ত?

দেশের বাইরে থাকা নাগরিকরা যে কেবল দেশের সমালোচক, তা নয়—তারা অধিকাংশই ভালোবাসা, দুঃখ আর উদ্বেগ নিয়ে দূর থেকে সৎ বিশ্লেষণ করেন।
গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য যদি দেশের ভেতরের মানুষ রাজপথে রক্ত দেয়, তাহলে বিদেশে থাকা সৎ নাগরিকদের দায়িত্ব হয় সেই সত্যগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরা। “দেশে আসেন” বলার আগে ভাবা দরকার, কেন এত মানুষ আজ দেশান্তর?

জামাত-বাম বিতর্ক: দায়ভার কার?


অনেকে বলছেন, আজ যারা জামাতকে গালি দিচ্ছেন, তারাই আগে সুবিধামতো জামাতকে সহ্য করেছিলেন। কথাটা একপাশে ঠিক হলেও, অপরাধের দায় কখনো সমান হয় না। জামাত যেমন মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে, তেমনি বামদের একাংশও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে সমাধান কোনো দলকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা নয়—বরং জনগণের মাধ্যমে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করা, এবং যুদ্ধাপরাধ বা রাষ্ট্রবিরোধমূলক অপরাধে বিচার নিশ্চিতে একমত হওয়া।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক

প্রতিবেশিরা কখনো বন্ধু, আবার কখনো স্বার্থান্বেষী—এটাই রাজনীতির বাস্তবতা। ১৫ বছর ধরে ভারত নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। আজ সেই সমর্থন প্রশ্নবিদ্ধ।
বিদেশি শক্তির প্রভাব যতই থাকুক, জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা ও আন্দোলন যে সেই চাপকে প্রতিহত করতে পারে, ২০২৪ সালের আন্দোলন তার বড় প্রমাণ।


দায়ভার আপনার-আমার সবার

আজকে দেশের জন্য সবচেয়ে দরকার গালি নয়, যুক্তি দিয়ে কথা বলা। “তারা বাম, তারা জামাত”—এই তকমা দিয়ে সত্য আড়াল করা যাবে না।
গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এখন দরকার ন্যায়বিচার, ট্রানজিশনাল জাস্টিস এবং নীতিবান নেতৃত্ব। দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু আবেগ থাকা নয়—সত্য বলার সাহস রাখতে হয়।
এই দেশ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; এদেশ হচ্ছে আপনার, আমার, আমাদের সকলের।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১৬৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন