২৩ জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ: হতাহত ও নিখোঁজের ভয়াবহ বাস্তবতা

বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫ ৮:১২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২৩ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম রক্তাক্ত ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে জমে ওঠা ছাত্র ও জনতার ক্ষোভ এই দিনে চূড়ান্ত বিস্ফোরণে রূপ নেয়।
সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, মেডিকেল কলেজ চত্বর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ দেশের বড় শহরের রাস্তায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ-অবরোধে অংশ নেন। অবরোধের কারণে যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, জনজীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় স্থবিরতা। ঢাকা ও শহরতলী, আবাসিক এলাকাতেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা ও ৫৮টি জেলার ৪১৭টি থানায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি গুলি চালানোর আদেশ দেয়। পুলিশের, র্যাব ও বিজিবির কড়া তৎপরতার পাশাপাশি সরকারি ছাত্র সংগঠনসহ (বিশেষত ছাত্রলীগ) আন্দোলন দমনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে, অনেক জায়গায় মারধর, লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্লক রেইড, রাতভর ধরপাকড়, ছাত্রনেতা ও সাধারণ মানুষের নিখোঁজ, এবং কয়েকটি স্থানে অপহরণের তথ্য উঠে আসে। বেশ কিছু আন্দোলনকারী কিংবা সংগঠক পরিবার থেকে হারিয়ে যান, কারও পরিবার বা আইনজীবীরা তথ্য-সূত্র পেতে ব্যর্থ হন। হাসপাতালে আহতদের অবস্থা জানাতে গেলে সাংবাদিকদেরও বাধা দেয়া হয়; অনেক ‘বেওয়ারিশ’ মরদেহ গোপনে দাফন করা হয়, প্রকৃত শহীদ সংখ্যার তথ্য সংগ্রহ সীমিত হয়।
এই দিন নিহতের সংখ্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা, হাসপাতাল এবং খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, অন্তত ৭৯ থেকে ১৫০-১৭৪ জনের মধ্যে প্রমাণিত প্রাণহানি ঘটে — আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘসহ বহু সংগঠন একে “স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন” বলে আখ্যা দেয়। হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হন; অনেকের জীবনে স্থায়ী পঙ্গুত্ব, অঙ্গহানি বা দৃষ্টিশক্তি হারানোর মতো ঘটনা ঘটে। হাসপাতালে ঠাঁই হয়নি বহু আহতের, চিকিৎসক-সেবিকা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেন। ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ থাকায় পরিবার, গণমাধ্যম, এমনকি সংবাদের সংস্থানেও নিরাপত্তার সংকট ও বিভ্রান্তি দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদপ্রবাহও বিভ্রাটের শিকার হয়।
২৩ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশ সরকার সরকারি চাকরিতে কোটার নতুন গেজেট প্রকাশ করে। এতে ৯৩% পদ মেধার ভিত্তিতে এবং ৭% পদ কোটাভিত্তিক নির্ধারিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, তৃতীয় লিঙ্গ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য পৃথক কোটা রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আগের গেজেট বাতিল করে নতুন গেজেট কার্যকর হয়।
দুটি প্রধান বিষয় ২৩ জুলাইয়ে স্পষ্ট: একদিকে আছে শিক্ষার্থী ও জনতার দীর্ঘস্থায়ী ন্যায্য অধিকার আন্দোলন, আরেকদিকে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন, দমন ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের নজিরবিহীন সহজাত প্রতিক্রিয়া। অনেক এলাকায় শিক্ষার্থী, পথচারী, শিশু–কিশোর পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ ও নিহত হন; আবার সরকারি ছাত্র সংগঠন, যুবলীগ কিংবা স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি বেশকিছু এলাকায় আন্দোলন দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সরকারি স্থাপনা, নেতাদের কার্যালয়, এমনকি আবাসিক ভবনেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হামলার তথ্য পাওয়া যায়। রাত পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা না হলেও সেনা, পুলিশ ও র্যাবের টহল ছিল সর্বত্র, বহুজন ঘরবন্দী অবস্থায় দিন কাটান।
বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ঘিরে ২৩ জুলাইয়ের সংবাদ আন্তর্জাতিক উত্তেজনার জন্ম দেয়। আল-জাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, সিএনএন, ফ্রান্স ২৪, রয়টার্স, মানবাধিকার সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ—সবাই বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে “স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী-জনতার বিদ্রোহ”, “সরকারের সেনাবাহিনী দ্বারা রক্তাক্ত দমন”, “shoot-at-sight কারফিউ ও তথ্য ব্ল্যাকআউট” হিসেবে প্রতিবেদনে তোলে। কেবল মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট নয়; গ্রেফতার-নিখোঁজ শ্রমিক-সাংবাদিক-নাগরিকদের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল সরাসরি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ জানায় এবং দ্রুত তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিবেচনার দাবি তোলে।
২৫শে মার্চ, ৭ই মার্চ, ২১শের ফেব্রুয়ারির মতো ২৩ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বেদনাদায়ক অধ্যায়ে ছাপ ফেলে। এই দিন সারাদেশে গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল, শহীদ স্মরণ, গণ-অবস্থান, শিক্ষক সমাবেশ, অনশন ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাতে কিছু আন্দোলনকারী চাপের মুখে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করলেও হাজার হাজার মানুষ রাজপথে থেকে যাওয়ায় সম্মিলিত ক্ষোভ আর শোক ইতিহাস হয়ে ওঠে। সংবাদ মাধ্যম সেন্সর, হাসপাতালের প্রতিবন্ধকতা, মোবাইল-ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা—সবকিছু সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক চেতনায় এই দিন রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে সাধারণ মানুষের ন্যায্য নির্ভীকতার সাক্ষ্য হয়ে আছে।
১৩০ বার পড়া হয়েছে