মতামত

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: একটি প্রজন্মের করুন কাহিনী

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫ ১২:০১ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
২১ জুলাই ২০২৫। দুপুর ১টা ১৫ মিনিট। রাজধানীর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের একটি প্রশিক্ষণ বিমান।

মুহূর্তেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে, আগুনে পুড়ে ও চাপা পড়ে প্রাণ হারায় স্কুলের ২৫ জন শিশু শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩১ জন। আহত হন আরও ১৭০ জনের বেশি (এই লেখনি লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত), যাদের অধিকাংশই এখনো ঢাকা মেডিকেল, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, ও উত্তরের একাধিক হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অনেকে দগ্ধ, কেউ কেউ শ্বাসনালিতে ক্ষত নিয়ে কথা বলারও অবস্থায় নেই।

 

এই মুহূর্তে জাতি একটি গভীর শোক, হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নানা দুর্যোগ-দুর্ঘটনা আমরা দেখেছি; কিন্তু নিরপরাধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদে বসে থাকা কোমলমতি শিশুদের উপর এমন মৃত্যু এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমন নির্মমতা কেউ কল্পনাও করেনি।

দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান- মোট প্রাণহানি ৩১ জন
নিহত শিক্ষার্থী ২৫ জন
নিহত শিক্ষক ও অন্যান্য ৬ জন (তন্মধ্যে ১ জন শিক্ষক, ১ জন পাইলট) আহত প্রায় ১৭১ জন
আইসিইউতে দগ্ধ ও আশঙ্কাজনক অন্তত ২৪ জন
হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসা চলমান ৮৮ জন।

প্রশ্ন জাগে—যে বিমানে সমস্যা ছিল, সেটি কেন জনবহুল এলাকায় উড়ছিল? প্রশিক্ষণ কেন একটি জনাকীর্ণ স্কুলের ছাদ বরাবর করা হচ্ছিল? পাইলটের দক্ষতা বা মেশিনের কারিগরি ত্রুটি—সবকিছু একত্রে তদন্তযোগ্য বটে, তবে এর পেছনে রয়েছে একটি দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত ব্যর্থতা, যার নাম স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স।

 

বিপদের সময় আমরা সান্ত্বনা দিই, সাহায্য পাঠাই, তদন্ত কমিশন গঠন করি—তারপর সবকিছু হারিয়ে যায় কাগজপত্রে। কিন্তু নিহত শিশুদের অভিভাবকরা কি ভুলে যেতে পারবেন এই ক্ষত? যাদের সন্তানদের বই খাতা এখন পোড়া ছাই হয়ে গেছে, তাদের জীবন কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক হবে?

 

রাষ্ট্রের একেকটি পদক্ষেপ যদি জীবনরক্ষা না করতে পারে, তাহলে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্রে বাস করছি?
প্রশিক্ষণ বিমান শহরের বাইরে নেওয়ার নিয়ম থাকা সত্ত্বেও তা মানা হয়নি।
যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও স্কুলের ওপর দিয়ে ওড়ানো হয়েছে প্রশিক্ষণ বিমান।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, অগ্নিনির্বাপক প্রস্তুতি, হাসপাতাল সমন্বয়—সবই ঘটনার পর ‘চেষ্টা’ হিসেবে দেখা গেছে, পূর্ব-প্রস্তুতির অভাব ছিল প্রকট।
জনসচেতনতার অভাবে উদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করেছে উৎসাহী জনতার ভিড়।

 

স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্র- সরকার বলেছে বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এখনো নিজেদের চিকিৎসাসেবা এমনভাবে গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে এই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলায় আমরা নিজেরাই যথেষ্ট হই? ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যদি আমরা ঢাকায় একটি দুর্ঘটনার চিকিৎসায়ও স্বনির্ভর না হতে পারি, তাহলে আমরা কীভাবে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগোচ্ছি?
তথ্য বলছে, বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন শিশুদের মধ্যে ৭ জন এখনো ভেন্টিলেশনে, আরও অন্তত ১৭ জনকে রিফার করতে হয়েছে দেশের বাইরে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা, মানসিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়।

মানসিক আঘাত: শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়, যারা এই বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে—তারা দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাবে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা, উদ্ধারকারীরা, এমনকি শিশুদের সহপাঠীরাও এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা সহজে ভুলতে পারবে না। মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সরকার ও প্রশাসনের উদ্যোগ এখনো নগণ্য। এই প্রেক্ষাপটে একটি জরুরি প্রশ্ন—রাষ্ট্র কি মানসিক পুনর্বাসনকে একটি নীতিগত অগ্রাধিকার দেবে?

তদন্ত কমিশন: শুধুই রুটিন কাজ? ঘটনার পর বিমান বাহিনী এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু বিগত অভিজ্ঞতা বলছে, এসব তদন্তের রিপোর্ট সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না, দায়ী কেউই শাস্তির মুখ দেখে না। ২০১৯ সালে ময়মনসিংহে বিমান দুর্ঘটনা, ২০২১ সালে রাডার বিভ্রাট, এমনকি সাম্প্রতিক কক্সবাজারে দুর্ঘটনার রিপোর্ট কোথায়?
এইবার কি আমরা দেখতে পাব দায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের শাস্তি? নাকি তদন্তের ধুলোয় চাপা পড়বে আরও একটি প্রজন্মের মৃত্যু?

প্রতিকারের নয়, প্রতিরোধের নীতিতে ফিরুন

 

১.প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা: জনবহুল এলাকাকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে প্রশিক্ষণ বিমানের জন্য।
২.স্বাস্থ্যখাতে জরুরি প্রস্তুতি বৃদ্ধি: বার্ন ইউনিট, শিশু হাসপাতাল এবং ICU এর সংখ্যা ও মান বাড়াতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
৩.মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বাধ্যতামূলক করতে হবে: ট্রমা ইউনিট ও কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক করতে হবে স্কুলভিত্তিক বিপর্যয়ের পর।
৪.তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও দায় নির্ধারণ: রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।
৫.জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম ক্যাম্পেইন: উদ্ধারকাজে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করতে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

 

আর কত মৃত্যু? যারা নিহত হয়েছেন, তারা আর ফিরবেন না। কিন্তু আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিই, তাহলে সামনে আরও শিশুর মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যায় পরিণত হবে।

২১ জুলাই একটি দুর্ঘটনার দিন নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দিন। একটি দুর্বল, অদূরদর্শী ব্যবস্থাপনা কীভাবে জাতির ভবিষ্যৎকে শেষ করে)) দিতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
এখন সময় একটাই—কান্না নয়, কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি।

লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা।

২১১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন