২২ জুলাই ২০২৪
রক্তাক্ত ছাত্র-আন্দোলনের দিনে ১৮০ নিহত: ব্যবসায়ীদের দালালীর দিন

মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫ ৭:৩৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে ২২ জুলাই ২০২৪, সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিনের মধ্যে একটি দিন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের প্রধান প্রধান শহর, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র-শিক্ষক ও নাগরিক সমাজ “কোটা সংস্কার” এবং বৈষম্যবিরোধী দাবিতে বিশাল সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন।
সংগঠিত হয় মহাসড়ক অবরোধ ও আদালত চত্ত্বরে বিক্ষোভ, যেখানে শিক্ষকদেরও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল পুলিশের বাঁধা, সংঘর্ষ এবং হামলার আতঙ্ক। আন্দোলনের মাঝেই দিনভর বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলে এবং নিহত, আহত ও গ্রেপ্তার হন অসংখ্য মানুষ।
সরকার এদিন ভোর থেকেই রাজধানীসহ সব বড় শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে চিরুনি অভিযান শুরু করে এবং ঢাকাতেই কয়েক ঘণ্টায় ৫০০-৬০০ জন আন্দোলনকারী আটক হয়। সারাদেশে ১৬৪টির বেশি মামলা দায়ের হয় এবং রাত থেকেই নেমে আসে কারফিউ। সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় প্রধান প্রধান শহর, মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়, চালু ছিল “শুট-অ্যাট-সাইট” নির্দেশ। পুলিশের পাশাপাশি সরকারি ছাত্র সংগঠনের হামলায় বহু শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হন।
নিহত ও আহতের তালিকা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, শুধুমাত্র ২২ জুলাই সরকারি তথ্যানুযায়ী সাধারণ আন্দোলনকারী নিহত হয় ১৬০–১৮০ জন; আন্দোলনকারীদের মতে ৩০০-এরও বেশি। তবে এ আন্দোলনের দিনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যেরাও হতাহত হন—সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দিনটিতে ৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত এবং শতাধিক আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর আঘাত পেয়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। শিশু, পথচারী, সাংবাদিকদের হতাহতের খবরও আসে, বহু মানুষ হাসপাতালে নেন এবং বহুজন নিখোঁজ হন। একই সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ প্রধান শহরের পুলিশ ও প্রশাসনিক বাহিনীর ওপরও আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও হতাহত হয়ে পড়ে।
এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীতে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন; তিনি কোটা সংস্কার সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাগজে স্বাক্ষর দেন ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এবং বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেন।
২২ জুলাই ২০২৪ বিকেলে ঢাকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলমান সহিংস আন্দোলন, কারফিউ এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, FBCCI সভাপতি মাহবুবুল আলম, বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, BKMEA এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম, লেদার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, PRAN-RFL চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী এবং বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বৈঠকে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান মূলত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন চালু রাখার পক্ষেই অবস্থান নেন। তিনি সভায় সরকারের সিদ্ধান্ত ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানান। দেশীয় শিল্প ও ব্যবসায়িক পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে সরকারের যে কোনো উদ্যোগে বসুন্ধরা গ্রুপ বরাবরের মতো সক্রিয় থাকবে বলে জানিয়েছেন। ব্যবসায়িক মহলে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, দেশের সংকটময় মুহূর্তে “জাতির আশা-ভরসার স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া দেশের অগ্রগতি ও শান্তি বজায় রাখা অসম্ভব”—এমন কথাই বৈঠকে প্রকাশ পায়। FBCCI সভাপতি মাহবুবুল আলম সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন এবং চলমান অস্থিতিশীলতায় ব্যবসায়ী সমাজ সরকারের পাশে আছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বরাবরের মতো ঐক্যবদ্ধ; দেশের যেকোনো কঠিন সময়ে ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানাবে। শিল্প-কারখানা, বাণিজ্য ও আর্থিক কার্যক্রম সচল রাখতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় সব ধরনের সহযোগিতা করব।’’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘‘আপনিই দেশ, আপনিই জনগণের বিশ্বাস—আপনার নেতৃত্বেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই।’’
১৮ জুলাই থেকেই চলা ইন্টারনেট ও ব্ল্যাকআউট ২২ জুলাইও প্রবল ছিল। মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ফেসবুক-ইন্টারনেট ভিত্তিক সব ধরনের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে, ফলে সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের তথ্যপ্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
সরকারি দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এই দিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাসে সশস্ত্র হামলা, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতন এবং গ্রেপ্তার ও নিপীড়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তীব্র আলোচিত হয়।
সারাদেশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর “ব্লক রেইড”, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক-নাগরিক গ্রেপ্তার ও শত শত মামলা এবং অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্য, অধিকারকর্মী, প্রতিবাদী নাগরিকরা এসব নিখোঁজ ও গ্রেফতারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং আইনী উদ্যোগ নেন।
জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটসওয়াচসহ জরুরি মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও চরম বলপ্রয়োগের নিন্দা জানায়, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি তোলে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারতসহ বহু দেশ নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে।
১৬ জুলাই থেকেই দেশের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও আবাসিক হল খালির নির্দেশ বলবৎ ছিল। বাজার-চিকিৎসা-পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়। ২২ জুলাইয়ের আর্থিক ক্ষতি দেশের প্রযুক্তি ও ব্যবসা খাতে বাড়তি অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
দিন শেষে আন্দোলনরত ছাত্র সংগঠনগুলো আরও ৪৮ ঘণ্টা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়, সহিংসতা বন্ধ, ইন্টারনেট চালু, গ্রেপ্তার মুক্তি ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবি তোলে। সর্বোপরি, ২২ জুলাই ২০২৪ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ছাত্র সৌর্য ও দেশের চেতনাকে এক রক্তাক্ত, সংগ্রামী অধ্যায় হিসাবে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করল।
১২৭ বার পড়া হয়েছে