লিবিয়ায় ফাঁদে সাতক্ষীরার তিন যুবক, অমানবিক নির্যাতনে মুক্তিপণ দাবি

সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫ ৭:৩০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের হাতে বন্দি হয়েছেন সাতক্ষীরার তিন যুবক।
বর্তমানে তারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। পাচারকারীরা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারগুলোর কাছে কোটি টাকার মুক্তিপণ দাবি করছে।
বন্দি তিন যুবক হলেন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের রেজোয়ান ও আবু শহিদ গাজী এবং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের রমজান। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তারা দালালের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা হয়ে কয়েকটি দেশ ঘুরে লিবিয়ায় পৌঁছান।
পরিবারগুলোর অভিযোগ, প্রতিজনকে লিবিয়া পাঠাতে ১৮ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে দালালরা। জমি বিক্রি, ঋণ ও জমানো টাকা দিয়ে এই অর্থ জোগাড় করে এখন নিঃস্ব তারা। কিন্তু ইউরোপ পৌঁছানো তো দূরের কথা, তাদের সন্তানরা আজ লিবিয়ার বন্দিশিবিরে অমানবিকতার শিকার।
প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া পরিবার
আবু শহিদ গাজীর ভাই শহিদুল ইসলাম জানান, ‘ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন ভাইয়ের নির্যাতনের ভিডিও, অডিও পাচ্ছি। ওরা কাঁদে, সাহায্য চায়। এক পর্যায়ে হাতের নখ তুলে নেওয়ার ভিডিও পাঠায়। আমরা পাঁচ লাখ টাকা দিই, এরপরও আবার চায়। এখন পর্যন্ত আমরা তিন পরিবার মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিই। আর পেরে উঠছি না।’
রেজোয়ানের ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, ‘টাকা নেই, কিন্তু ভাইটারে বাঁচাতে চাই। মুকুল নামে এক দালাল সব নিয়ন্ত্রণ করে, সে দুবাইয়ে বসে এসব চালায়। তার সহযোগীরা এখানেও আছে।’
দালাল চক্রের মূল হোতা ‘মুকুল’ ও তার টিম
ভুক্তভোগীরা জানান, মানবপাচারের মূল হোতা শ্যামনগরের মুকুল সানা। তিনি দুবাই থেকে একটি চক্র পরিচালনা করেন। তার হয়ে দেশে কাজ করেন স্ত্রী মোমেনা বিবি, দুলাভাই রেজাউল, শ্যালক শাহিনুরসহ ছয় থেকে সাতজন। তাদের বিরুদ্ধে শ্যামনগর থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করা হয়েছে।
এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন দাতিনাখালী, শৈলখালী, ঘুমানতলী ও সাহেবখালী গ্রামের মোট ১৫ জন। মামলা তদন্ত করছে সাতক্ষীরার পিবিআই। এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা অনিমেশ কুমার মন্ডল।
লিবিয়ায় আটক হাজারো বাংলাদেশি, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লিবিয়ার ত্রিপোলি, বেনগাজী ও মিশ্রাতার বিভিন্ন ক্যাম্পে বর্তমানে ৫০০’র বেশি বাংলাদেশি আটকে আছেন। তাদের উপর চলেছে ভয়াবহ নির্যাতন। লিবিয়ার কিছু মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাচারকারীরা এই নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর তথ্যে জানা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন ২ হাজার ৬৭০ জন বাংলাদেশি। চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই ইতালিতে পৌঁছেছেন ২ হাজার ৫৮৯ জন, যা সেই সময়ের মোট প্রবেশকারীদের ৪২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও সুপারিশ
অভিবাসন বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বলেন, "এই ট্রেন্ড অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মানুষের স্বপ্নকে কাজে লাগিয়ে দালালচক্র একটি ভয়াবহ ব্যবসা গড়ে তুলেছে। মানবপাচার আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বৈধ অভিবাসন পথ নিশ্চিত না হলে এমন ঘটনা আরও বাড়বে। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি ও দক্ষ শ্রমিক তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে।"
চলমান অভিযান ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
সাতক্ষীরা পিবিআই জানিয়েছে, আসামিদের তথ্য ইমিগ্রেশনে দেওয়া হয়েছে এবং পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবু, পরিবারগুলোর দাবি—সবচেয়ে জরুরি এখন তাদের সন্তানদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা।
১১৭ বার পড়া হয়েছে